ধ্যান
"ধ্যান" — লক্ষ্যে স্থিতি যদি অনন্যচিত্ততাসহকারে হয়, তবে তাহাকে ধ্যান কহে। কোনও পর্দাথ তুমি লক্ষ্য করিয়াছ অর্থাৎ জানিতে ইচ্ছা করিয়াছ। উহা সাকারই হউক বা নিরাকারই হউক তদ্বিষয়ে কোন প্রভেদ নাই । কিন্তু তৎকালে যদি চিত্ত অন্য বিষয়ে না যায়, তবে ঐরূপ চিন্তনকে ধ্যান কহে ।
পতঞ্জলি বলেন যে,—
দেশবন্ধ শ্চিত্তস্য ধারনা,
তত্র প্রত্যয়ৈকতানতা ধ্যানম্।
অর্থাৎ চিত্তকে কোনও পদার্থে বন্ধ করার নাম ধারণা। আর তৎপদার্থে যদি জ্ঞানের একতানতা হয়, তবে তাহাকে ধ্যান কহে ।
ধ্যানং শূন্যগতং মনঃ।
অর্থাৎ শূন্যগত মনকে ধ্যান কহে।
ধ্যান সম্বন্ধে ঘেরণ্ড ঋষি বলেন যে,—
স্থূলং জ্যোতি স্তথা সূক্ষ্মং
ধ্যানন্তু ত্রিবিধং বিদুঃ।
অর্থাৎ স্থূলধ্যান, জ্যোতির্ধ্যান ও সূক্ষ্মধ্যানভেদে ধ্যানকে ত্রিবিধ বলিয়া জানিবে।
গুরুদেবের ধ্যানকে স্থূলধ্যান ও তেজোময় ব্রক্ষের ধ্যানকে জ্যোতিধ্যান কহে এবং কুণ্ডলিনী শক্তি জাগ্ৰতী হইলে (তত্ত্বজ্ঞানোদয় হইলে), উহা জ্যোতির্ম্ময়ভাবে আত্মার সহযোগে নেত্ররন্ধ হইতে বিনির্গত হয়, চঞ্চলত্বহেতু সম্যগ্ রূপে দেখা যায় না । ঐরূপ অবস্থাপন্ন হইয়া যে পরব্রহ্মের ধ্যান, তাহাকে সূক্ষ্ম ধ্যান কহে। স্থূলধ্যান হইতে তেজোধ্যান শত গুণ এবং তেজোধ্যান হইতে সূক্ষ্মধ্যান লক্ষ গুণ।
( ১. ধ্যায়েত্তত্র গুরুং দেবং দ্বিভুজঞ্চ ত্রিলোচনম্। ২. ধ্যায়েৎ তেজোময়ং ব্রহ্ম তেজোধ্যানং পরাৎ পরম্। ৩. তেজোধ্যানং শ্রুতং চণ্ড, সূক্ষ্মধ্যানং বদাম্যাহম্। বহুভাগ্যবশাদ্ যস্য কুণ্ডলী জাগ্রতী ভবেৎ। আত্মনঃ সহযোগেন নেত্ররন্ধাদ্ বিনির্গতা বিহরেদ্ রাজমার্গেচ চঞ্চলত্বান্ন দৃশ্যতে। ৪. স্থূলধ্যানাচ্ছতগুণং তেজোধ্যানং প্রচক্ষতে। তেজোধ্যানাল্লক্ষগুণং সূক্ষ্মধ্যানং পরাৎপরম্ ।। -- ঘেরণ্ড সংহিতা।)
সাংখ্যমতাবলম্বীরা বলেন যে, —
রাগোপহতি র্ধ্যানম।
বৃত্তিরোধাৎ তৎ সিদ্ধিঃ ।।
অর্থাৎ আশক্তিশূন্যতাকে ধ্যান কহে। চিত্তবৃত্তির নিরোধে ধ্যান-সিদ্ধি হয় ।
ধ্যানের মূল একাগ্ৰচিত্ত অর্থাৎ চিত্তের একাগ্ৰতা না হইলে প্রকৃত ধ্যান হয় না, পক্ষান্তরে ধ্যানাভ্যাসেও চিত্ত একাগ্ৰ হয়। ধ্যানদ্বারা বিভূতি লব্ব হয় এবং বিভূতির ত্যাগে তত্বজ্ঞান জন্মে।
ধ্যানাবস্থায় যাহা দেখা যায় ও জানা যায়, তাহা নিম্নে লিখিত হইল। —
দৃশ্যতে জ্ঞায়তে চৈব
ধ্যানস্থেন মনস্বিনা ।
প্রথম মন্ধতমসং
দ্বিতীয়ং বিরলং তমঃ ।।
তৃতীয়ং স্বল্পকালস্থা
মূর্ত্তি র্বা দীর্ঘকালগা ।
তূর্য্যং সুরাণাং জ্যোতীংষি
পঞ্চমং ভাষণং সুরৈঃ ।।
ষষ্ঠে তেজো ব্রহ্মণশ্চ
সপ্তমে ব্রহ্মদর্শনম্।
এতেষাং বিবৃতিজ্ঞেয়া
শ্রীগুরুো র্বদনাম্বুজাৎ।।
অর্থাৎ ধ্যানস্থ মনস্বী মানব ধ্যানকালে নিম্নলিখিত সাতটী বিষয় দর্শন করেন বা জানিতে পারেন।
যথা,—
প্রথম । ঘোরতর অন্ধকার।
দ্বিতীয় । বিরল অন্ধকার।
তৃতীয় । স্বল্পকালস্থায়িনী বা দীর্ঘকালস্থায়িনী মূর্ত্তি।
চতূর্থ । দেবজ্যোতিঃ ।
পঞ্চম । দেবগণের সহিত কথন ।
ষষ্ট । ব্রহ্মতেজোদর্শন ।
ব্রহ্মদর্শনের পূর্ব্বে যাহা দেখা যায়, তদ্বিষয়ে মতভেদ আছে । যথা,—
বহবো দেবা বীক্ষ্যন্তে ইতি সিদ্ধাঃ ।
অর্থাৎ বহুদেবের দর্শন হয়, ইহা সিদ্ধেরা বলেন ।
ভীমকায়া বহবো দৃশ্যন্তে ইতি তান্ত্রিকাঃ ।
অর্থাৎ ভীমাকৃতি বহুপদার্থ দৃষ্ট হয়, ইহা তান্ত্রিকেরা বলেন।
নীহার- ধূমার্কানিলানলানাং
খদ্যোতবিদ্যুৎ- স্ফটিক- শশিনাম্ ।
এতানি রূপাণি পূরসরাণি
ব্রক্ষণ্যভিব্যক্তি - করাণি যোগে ।।
— ইতি শ্বেতাশ্বতরোপনিষৎ ।
অর্থাৎ শিশির, ধূম, সূর্য্য, অনিল, অনল, খদ্যোত, বিদ্যুৎ, স্ফটিক ও চন্দ্র এই সকল ক্রমশঃ অভিমুখে আসিয়া ব্রহ্মদর্শন প্রকাশ করে ।
ঈশ্বরধ্যানে জাতগুণের লয়, লয়শীল মিশ্রগুণের লয়, অলয়শীল মিশ্রগুণের বৃদ্ধি এবং সরলগুণের পরমোন্নতি হয়।
বহুসংখ্যক ব্যক্তি ধ্যানজ্ঞানাভাবে বলেন যে, নিরাকারের ধ্যান হইতে পারে না, কিন্তু তাহা যে অসঙ্গত, তাহা ধ্যানপরায়ণ ব্যক্তি মাত্রেই বুঝিতে পারেন।
ধ্যান স্থূল ও সূক্ষ্মভেদে দ্বিবিধ। স্থূলদেহধারীর যে পূর্ব্ববৎ চিন্তন, তাহাই স্থূলধ্যান এবং সূক্ষ্মপদার্থের অর্থাৎ সূক্ষ্মদেহী, কারণদেহী বা দেহাতীত পরমেশ্বরের যে পূর্ব্ববৎ চিন্তন, তাহাই সূক্ষ্মধ্যান বলিয়া কথিত হয়। এই বিভাগ তন্ত্রশাস্ত্রানুসারে লিখিত হইল।
পরমপিতা পরমেশ্বরের বিষয়ে যে ধ্যান, তাহাই সূক্ষ্মধ্যান এবং গুরুদেবের যে ধ্যান, তাহাই স্থূলধ্যান। অন্য কাহারও ধ্যানের প্রয়োজন নাই । অনেকে বলেন যে সূক্ষ্ম ধ্যানে অসমর্থ মানবের পক্ষে দেবদেবীর স্থূলধ্যান করা কর্ত্তব্য। কেননা স্থূলধ্যান বিষয়ে কৃতার্থ হইলেই সূক্ষ্মধ্যানে সামর্থ হইতে পারে। ইহার উত্তরে বক্তব্য এই যে, ব্রহ্মধ্যানে অসমর্থ এরূপ মানব যে পৃথিবীতে আছে, এরূপ বোধ হয় না।
তথাপি যদি কোন ব্যক্তি আপনাকে তদ্রূপ বোধ করেন, তবে তিনি দেবদেবীর ধ্যান না করিয়া গুরুদেবের ধ্যানদ্বারা সিদ্ধমনোরথ হইতে পারিবেন। আর ইহাও অবশ্য বক্তব্য যে, সাধকের নিকট গুরু হইতে প্রধান দেবদবী নাই। সুতরাং তিনি প্রধানকে পরিত্যাগ করিয়া অপ্রধানকে কেন অবলম্বন করিবেন ? (দেবদেবীগণ গুরুদেব হইতে উন্নত বা অবনত অথবা তাহার তুল্য হইতে পারেন বটে, কিন্তু শিষ্যের পক্ষে মূল-লিখিত বোধই আবশ্যক। তথাহি — মদ্ গুরুঃ শ্রীজগদ্ গুরুঃ।)
এ স্থূলে প্রসঙ্গ-ক্রমে নিরাকার ও সাকারের উপাসনা ও পূজা সম্বন্ধে কিছু বলা বোধ হয় অসঙ্গত নহে। কেহ কেহ বলেন যে, "নিরাকার ধারণায় অনুপযুক্ত ব্যক্তিগণের পক্ষে সাকারের উপাসনা করা কি কর্ত্তব্য নহে?" ইহার উত্তরে বক্তব্য এই যে, ধারণা শব্দের প্রকৃতার্থ চিন্তা করিয়া দেখিলে প্রতীয়মান হইবে যে, ঐ সম্মূখস্থিত তুলসী বৃক্ষটীও যখন সম্যক প্রকারে ধারণা করা যায় না, তখন অনন্ত অনন্ত গুণসম্পন্ন জগদীশ্বরের কথা দূরে থাকুক, তদীয় অংশ ও উপাসক দেবদেবী-গণকেও ধারণা করা সাধারণতঃ কাহারও সাধ্য নহে।
তবে যদি উপাসনার কথা বল, তবে ইহা জানিবে যে, সাকারের উপাসনা নাই, অর্চ্চনা আছে। এইরূপ জগদীশ্বরের পূজা নাই, উপাসনা আছে। অতএব জগদীশ্বরের উপাসকগণও প্রয়োজনানুরোধে বা ভক্তির অতিবৃদ্ধি-প্রযুক্ত দেবদেবী-গণের পূজা করিতে পারেন। কিন্তু সাবধান কখনও যেন সান্ত-শক্তি-সম্পন্ন দেবদেবীদিগকে অনন্ত-শক্তি-বিশিষ্ট জগদীশ্বর বলিয়া বোধ করিয়া অজ্ঞানতার ও তজ্জনিত মহাপাপে পতিত হইতে না হয়। দেবদেবীগণের পূজা কিরূপ, তাহা দৃষ্টান্তদ্বারা বুঝাইতেছি। মহারাণী ভারতেশ্বরী ভিক্-টোরিয়া দেবী পুত্রনির্ব্বিশেষে প্রজা পালন করিয়া গিয়াছেন।
এক্ষণে তদীয় প্রতিমূর্ত্তিকে পুষ্পমাল্যে সুশোভিত করিয়া তদীয় চরণ প্রণাম দ্বারা অর্চনাও যাহা, দেবদেবীগণের অর্চ্চনাও তাহাব্যতীত আর কিছুই নহে। কেহ কেহ প্রভাতে গাত্রোত্থান করিয়া মাতাপিতার তৈলচিত্র দর্শন ও প্রণাম করিয়া থাকেন। এবং কখনও কখনও কার্য্য-বিশেষে সিদ্ধিলাভ করিবার জন্য প্রার্থনাও করিয়া থাকেন।
মাতাপিতার এইরূপ পূজাও যাহা, দেবদেবীগণের পূজাও, ইহারই অনুরূপ। তবে প্রভেদ এই যুগে, দেবদেবীগণকে পূজক, পূর্ব্বদর্শনাভাবে কল্পিতরূপে নির্ম্মাণ করিয়া যায় কার্য্য করেন, মাতাপিতার প্রকৃত মূর্ত্তির নিকটে তাহাই করা হয়। মাতা-পিতার পূজার ন্যায় গুরুদেবের পূজাও জানিবে।
— ঈশ্বর গুরুনাথ সেনগুপ্ত।
0 মন্তব্যসমূহ