"সত্যেষ্ট"-ই সত্য-ধর্ম্মী।




   সত্যধর্ম্ম অবলম্বীগণ সত্যেষ্ট

   গুরুদেব "দম্পতীর ধর্ম্মালাপ"-এ কি বলিয়াছেন দেখা যাউক।  মাতাঠাকুরানী প্রশ্ন করিলেন-

   "পৃথিবীতে যত প্রকার ধর্ম্ম প্রণালী প্রচলিত আছে, এইগুলি সমুদায়ই কি সত্য? অথবা ইহাদিগের মধ্যে একটীও সত্য নহে?"

    ইহার উত্তরে গুরুদেব বলিতেছেন- "পৃথিবীতে যত প্রকার ধর্ম্ম প্রণালী প্রচলিত আছে সমুদাই, সত্য, কিন্তু যে ধর্ম্ম অনির্ব্বাচ্য বিষয়ের বর্ণনা করা হইয়াছে, তখনই সেই কিঞ্চিৎ অসত্যের সংশ্রব হইয়াছে, কারণ তাহা বাক্যে বলা যায় না, তাহা যদি বাধ্য হইয়া বাক্যে বলিতে হয়, তবে কাজে কাজেই কিঞ্চিৎ অসম্পূর্ণতা ঘটে।





 ইহা শুনিয়া মাতাঠাকুরানী প্রশ্ন করিলেন- যদি পৃথিবীর সকল প্রকার ধর্ম্ম প্রণালী সত্য হইল, তবে পরস্পর এত বিরোধ কেন?

   উত্তরে গুরুদেব কহিলেন- বিরোধ কেবল অজ্ঞানতার জন্য, নতুবা কি শাক্ত, কি বৈষ্ণব, কি শৈব, কি গানপত্য, কি সৌর, কি বৌদ্ধ, কি ইহুদী, কি খৃষ্টান, কি মুসলমান, সকলের ধর্ম্মই সত্য, সুতরাং ইহাঁরা সকলেই সত্যধর্ম্মাবলম্বী।

    ইহা শুনিয়া মাতাঠাকুরানী প্রশ্ন করিলেন- যদি এই সকল ধর্ম্মই সত্য হইল, তবে আবার সত্যধর্ম্ম প্রচারের প্রয়োজন কি?

   ইহার উত্তরে গুরুদেব বলিলেন- সত্যধর্ম্ম প্রচারের উদ্দেশ্য অখণ্ড, তন্মধ্যে কতকগুলি প্রধান প্রধান বিষয় তোমাকে বলিতেছি।




     প্রথমেই বলিলেন এই যে- পুর্ব্বোক্ত সমুদায় ধর্ম্ম প্রণালী আপাততঃ পরস্পর বিরুদ্ধবৎ প্রতীয়মান হইলেও বস্তুতঃ পরস্পর বিরুদ্ধ নহে, ইহা সাধারণ জনগণকে পরিজ্ঞাপিত করা সত্যধর্ম্ম প্রচারের প্রথম উদ্দেশ্য।

     দ্বিতীয়ত বলিলেন যে- উল্লিখিত ধর্ম্ম প্রণালী সমূহ অবলম্বন করিয়া অনেক অনেক মহাত্মা সিদ্ধ হইয়া গিয়াছেন বটে, কিন্তু এই পরিবর্ত্তনশীল জগতে শরীরের ন্যায় মনের অবস্থারও বংশ পরম্পরায় পরিবর্ত্তন সাধন হইতেছে। সম্প্রতি মনুষ্যের দেহের ও অন্তকরণের যেরূপ অবস্থা তাহাতে তাহারা আর পূর্ব্বানুষ্ঠিত কঠোর সাধনা করিয়া প্রায়শঃ সিদ্ধিলাভে সমর্থ নহে। এজন্য এই বর্ত্তমান সময়ে আমাদিগের গুরুদেব যেরূপ স্বল্পায়াস-সাধ্য সাধনার উপদেশ দিয়াছেন, তাহা সর্ব্ব সাধারণের ক্লেশ রাশি নিবারণার্থ সর্ব্বত্র প্রকাশিত করা সত্যধর্ম্ম প্রচারের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য।




     তিনি তৃতীয়তঃ বলিলেন যে- দেবদেবীগণ পূর্ব্বেও যেমন ছিলেন, এখনও তেমনি আছেন, পূর্বে তাঁহাদিগের অর্চ্চনা করিয়া যেরূপ ফল পাইত, এখনও প্রকৃত পূজা করিতে পারিলে তদ্রূপ ফলই প্রাপ্ত হওয়া যায়। কিন্তু পূজা পদ্ধতি প্রায় পূর্ব্ববৎ থাকিলেও উহার অন্তর্গত অতি প্রধান ও অতি গুহ্য ২।৪টি কথা স্থানে স্থানে নাই, বোধ পূর্ব্বতন পুজকগণ স্বীয় গৌরব রক্ষার্থে এগুলি গ্রন্থ হইতে তুলিয়া ফেলাইয়া দিয়াছিলেন, কারণ তাহা হইলে অন্যে ঐ পুস্তক দেখিয়া পূজা করিয়া আর ফল পাইবে না, কিন্তু তাঁহারা গুপ্ত অংশের পরিজ্ঞান সিদ্ধির ফল পাইতে পারিবেন। এইরূপ যে সকল অংশ গুপ্ত হইয়াছে, তাহা পুনঃ প্রচারিত করা সত্যধর্ম্মের তৃতীয় উদ্দেশ্য।




     গুরুদেব চতুর্থতঃ বলিলেন যে- কি শাক্ত শৈব বৈষ্ণবাদি ধর্ম্ম, কি বৌদ্ধ ধর্ম্ম, কি ইহুদী, খৃষ্টান ও মুসলমান ধৰ্ম্ম--সকল ধর্ম্মই এরূপ কতগুলি কথা আছে, যাঁহার অর্থ আপাততঃ কিছুই বুঝা যায় না, অথবা অতিশয় কুৎসিত বলিয়া জানা যায়, কিন্তু ঐ সমস্তের যে অতি উৎকৃষ্ট অর্থ আছে, তাহা না জানাতে ঐ সকল ধর্ম্মাবলম্বীরা স্ব স্ব ধর্ম্মের প্রতি ক্রমশঃ বীতরাগ হইতেছেন, একারণে তাহাদিগকে দৃঢ়তর রাখা এবং উল্লিখিত অস্ত্র সংকলনের অপহরণ পূর্ব্বক সত্য প্রকাশ সত্যধর্ম্মের চতুর্থ উদ্দেশ্য।




    পঞ্চম উদ্দেশ্যে বলিলেন যে- কোন একজন প্রকৃত ধর্ম্মার্থী কখনই হিন্দু, মুসলমান, খৃষ্টান প্রভৃতি সকল ধর্ম্মাবলম্বী বলিয়া পরিচিত হইতে পারেন না, অথচ যিনি প্রকৃতরূপে ধৰ্ম্মানুষ্ঠান করেন, তিনি ঐ সকল ধর্ম্মের কোনটীরই বিরোধী নহেন। সুতরাং তাঁহাকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায় যে, আপনি কোন ধর্মাবলম্বী, তবে তিনি কোনও প্রচলিত ধর্মের নাম করিতে পারেন না, কেননা তৎসমুদায়ই বর্ত্তমান সময়ে সম্প্রদায় বিশেষের মধ্যে নিবদ্ধ হইয়াছে বলিয়া সৰ্ব্বধৰ্ম্ম মৰ্ম্মভাব অপূরিত, একারণ তাঁহাকে বলিতে বাধা হইতে হয়, যে, যে ধৰ্ম্ম সত্য অর্থাৎ যথার্থ বিষয় সমূহে পরিপূর্ণ, যে ধৰ্ম্ম সত্য অর্থাৎ নিত্যকাল অনন্তকাল বিদ্যমান ছিল, আছে ও থাকিবে, এবং যে ধৰ্ম্ম সত্য অর্থাৎ সত্য স্বরূপ পরমপিতার একমাত্র অভিপ্রেত, আমি সেই ধৰ্ম্ম অবলম্বন করিয়াছি। এক্ষণেবিবেচনা করিয়া দেখউল্লিখিত ধৰ্ম্মের কোনও একটী নাম হইতে পারে না। কিন্তু যেমন জগদীশ্বর নিরুপাধি হইলেও ভক্তগণতাঁহাকে নানাবিধ নামে আখ্যাইত করিয়াছেন তদ্রূপ উল্লিখিত ধৰ্ম্মেরও নানারূপ নামকরণ হইয়াছে। কিন্তু যতগুলি নাম জগতে প্রচালিত হইয়াছে কোনটাই ব্যাপক নহে, সকল গুলি ব্যাপ্য, কেবল “ব্রাহ্মধর্ম্ম” এই নামটী ব্যাপক, কিন্তু উক্ত নামটী ধর্ম্মের মর্ম্ম প্রকাশক না হইয়া কেবল ধৰ্ম্মানুষ্ঠানের লক্ষ্যার্থের প্রকাশক হইয়াছে, এজন্য ঐ নামটীকেও সৰ্ব্বাঙ্গ সম্পন্ন বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায় না। মনে কর, একজন জিজ্ঞাসা করিলেন যে মহাভারতের রচয়িতা কে, ইহাতে যদি কেহবলে যে “পরাশরের পুত্র,” তবে উহা অসঙ্গত হইল না বটে, কিন্তু প্রণেতার প্রকৃত নাম জানা গেল না, কেবল তৎপরিবর্ত্তে তাঁহার একটী মাত্র বিষয়ের পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া গেল। এইরূপ ব্রহ্মধৰ্ম্ম বলিলে বুঝা যায় যে উহা ঈশ্বরবাদপূর্ণ ধৰ্ম্ম, এই মাত্র, কিন্তু অত্যাবশ্যক পূর্বোক্ত ত্রিবিধ অর্থ বুঝায় না। এই সমস্ত পর্যালোচনা করিয়া পারলৌকিক মহাত্মারা এই বিশ্বব্যাপী-সৰ্ব্বধৰ্ম্ম গর্ভ সৰ্ব্বাপেক্ষা ব্যাপকতম “সত্যধর্ম্ম” এই নাম নির্দেশ করিয়াছেন। তাঁহারা বলেন, সংস্কৃত ভাষা পার্থিব সমস্ত ভাষা অপেক্ষা ব্যাপক বলিয়া ইহার, “সত্য” শব্দ যাদৃশ ভাব প্রকাশক, অন্য সমস্ত ভাষায় তাদৃশ ব্যাপক শব্দের প্রচলন নাই। তথাপি অংশতঃ যাহা আছে তাহা অবলম্বন করিলে পূৰ্ব্বে পূর্ব্বেও এইরূপ নামই প্রদত্ত হইয়াছিল যথা— খৃষ্ট প্রচারিত ধৰ্ম্ম ‘ট্রু রিলিজেন’’অর্থাৎ সত্যধৰ্ম্ম নামে বিখ্যাত।  

   অতএব কেবল "সত্য" শব্দ ব্যাপক উহাকে অন্তরে ধারণ করাই একমাত্র কর্ত্তব্য এবং সেই ধর্ম্ম অর্থাৎ পথে চলাই মানব জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ