স্থূল দেহধারী পরমেশ্বর নহে।



           পরমেশ্বর নিরাকার।
   
     সূক্ষ্ম হইতে স্থূলের উৎপত্তি হইয়া থাকে, তবে স্থূলে অধিকতর গুণ কেন? এতদুত্তরে বক্তব্য এই যে, উৎপাদক সূক্ষ্মের গুণ সম্পূর্ণ ভাবে স্থূলে পরিণত  না হইয়া কিয়দংশ মাত্র স্থূলে দৃষ্ট হয় এবং অবশিষ্টাংশ, বিকার-জন্য অন্য গুণরূপে পরিণত হইয়া থাকে। ইহার দৃষ্টান্ত দেখ, --জলীয় বাষ্প ব্যাপ্তি-শীল, জলও ব্যাপ্তিশীল, কিন্তু জলের ব্যাপ্তিশীলতা পার্শ্ব দেশে, জলীয় বাষ্পের ব্যাপ্তিশীলতা পার্শ্বে, উর্দ্ধে ও অধোদেশে। আবার জলীয় বাস্পের রূপ সাধারণ ভাবে দৃষ্ট হয়‍ না, কিন্তু জলের রূপ তদ্রুপে দৃষ্ট হয়। অতএব উৎপাদক অপেক্ষা উৎপন্ন পদার্থ আপাততঃ অধিকতর গুণ বিশিষ্ট দৃষ্ট হইলেও বাস্তবিক তাহা হয় না। অপিচ, যদি এরূপ কারণে পাঠকের পরিতোষ না হয়, তবে স্বীকার করিলাম যে, উৎপন্নে যেন উৎপাদক অপেক্ষা প্রকৃত পক্ষেই অধিকতর গুণ দৃষ্ট হয়; তাহাতেই বা হানি কি? মনে কর, প্রকৃতি পুরুষ যোগে ত এই সৃষ্টি হইয়াছে। প্রকৃতিতে যত অধিক অবস্থায় পুরুষ-যোগ হইয়াছে; ততই অধিকতর গুণের উৎপত্তি হইয়াছে; সুতরাং সূক্ষ্ম ভূত অপেক্ষা স্থূল ভূতে অধিকতর গুণ দৃষ্ট হয়।



       উৎপাদক অপেক্ষা উৎপন্নে
      অধিকৃতর পরিচালনা শক্তি দৃষ্ট হয় কেন?

     প্রকৃতপক্ষে উৎপাদক আকাশাদি ভূত অপেক্ষা উৎপন্ন বায়ু প্রভৃতি ভূতে শব্দগুণ অধিক নহে। কেননা, যেরূপ সামান্য আঘাত প্রতি-ঘাতে বায়ু প্রভৃতিতে শব্দের উৎপত্তি হয়, ভূমি বা জল তদ্রূপ সহজে শব্দোৎপত্তি হয় না। তবে যে, বায়ু-মধ্যে শব্দের গতি প্রতি সেকেণ্ডে ১১০০ ফিট, জলে ৪৪০০ ফিট্ এবং কাষ্ঠ ও লৌহে এতদপেক্ষাও শব্দের গতি অধিক, অর্থাৎ বায়ু অপেক্ষা কাষ্ঠে ১০ হইতে ১৬ গুণ অধিক পরিমাণে শব্দের গতি বলিয়া, ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা পরীক্ষা করিয়াছেন, তাহার অর্থ অন্যরূপ। যে ব্যক্তি যেরূপ অবস্থাপন্ন তাহার পক্ষেই সেই অবস্থায় অধিকতর উপলব্ধি হয়। দরিদ্র চিন্তাশীল যেমন দারিদ্র-দুঃখের অনুভব করিতে পারেন, ধনী চিন্তাশীল কখনই উহার তদ্রুপ অনুভব করিতে পারেন না। আবার, সহস্রচিন্তা করিলেও, সহস্র বৃদ্ধি থাকিলেও, যাঁহার কখনও সন্তান-শোক ঘটে নাই, সে ঐ লোকের ভীমভাবে সম্পূর্ণ অনুভব করিতে পারে না। ফলতঃ, যে নিজে যেরূপ অবস্থাপন্ন, তাহার নিকটে তদ্রূপ অবস্থারই অধিকার অনুভব হইয়া থাকে। আমরা স্থূলতম দেহধারী, এইজন্য সর্ব্বাপেক্ষা স্থূলভূমির ক্রিয়া যেমন আমাদিগের অনুভবনীয় হয়, তদপেক্ষা সূক্ষ্ম পদার্থের ক্রিয়ার তাদৃশ অনুভব হইতে পারে না। এজন্যই ভূমিতে শব্দের গতির যত অনুভব করিতে পারি, জলবায়ু প্রভৃতিতে তত পারি না। নতুবা, লল বায়ু প্রভৃতির শব্দ-গুণ ভূমি অপেক্ষা অধিক ভিন্ন অল্প নহে। আরো দেখ, ভূমিতে শব্দের গতি যত অনুভব করিতে পারি, জলে তদপেক্ষা অল্প এবং বায়ুতে তাহা অপেক্ষাও অল্প অনুভব হয়।


    অপিচ, মনে কর, ক, খ ও গ নামক তিন ব্যক্তির মধ্যে খ জলে ডুব দিল, গ নামক ব্যক্তি খ এর নিকটে দাঁড়াইয়া রহিল। আর ক নামক ব্যক্তি খ ও গ হইতে দূরবর্ত্তী অংশে থাকিয়া ডুব দিয়া রহিল। এখন জলমগ্ন খ জল-মধ্যে যে শব্দ করিবে, জলমগ্ন ক দূরে থাকিয়াও তাহা শুনিতে পাইবে। কিন্তু অনিমগ্ন গ তাহার নিকটে থাকিয়াও উহা শুনিতে পাইবে না। অতএব দেখ, স্থূলাংশে অধিকতর সাদৃশ্য-সম্পন্ন বলিয়া খ এর শব্দ ক শুনিতে পাইল, কিন্তু সাদৃশ্যাভাব-জন্য অন্তরের অল্পতায়ও গ শুনিতে পাইল না। অপর, ভূমি-মধ্যে প্রোথিত ব্যক্তি-দ্বয় ভূমি-ব্যবধানে যত শীঘ্র বা যেরূপ শব্দ শ্রবণ করিতে পারে, জলনিমগ্নদিগের মধ্যে তদপেক্ষা শীঘ্র শব্দ শ্রুত হয় এবং বায়ু নিমগ্নগণ আরও শীঘ্র শ্রবণ করিতে সমর্থ হয়। অর্থাৎ আমাদিগের দেহ যখন যেরূপ অবস্থাপন্ন হয় তখনই তদ্রূপ পদার্থের শব্দাদি অধিকতর অনুভবনীয় হইয়া থাকে। এখন আমরা স্থূলতম দেহধারী, একারণে স্থূলতম পদার্থের অর্থাৎ স্থূল-তমভূত প্রধান পদার্থের শব্দাদির যেমন অনুভব করিতে পারি, তদপেক্ষা সূক্ষ্মভাবের তত পারি না এবং তাহা অপেক্ষাও যাহা স্থূক্ষ্মতর তৎসম্বন্ধে আরও পারি না। যখন আমাদিগের দেহ চতুর্থাভূত-প্রধান অর্থাৎ যখন আমাদিগের বায়বীয় দেহ, তখনবায়ুর শব্দাদি যেরূপ অনুভূত হয়, অন্যের তদ্রূপ হয় না । অর্থাৎ তেজ, জল ও ভূমির শব্দাদি তদপেক্ষা ন্যুনতর অনুভূতি হয়। দেহ হইতে বহির্গত অবস্থায় পৃথিবীস্থ সাধকগণের এবং মৃত্যুর পরে পারলৌকিক আত্মাদিগের-প্রধান দেহে অবস্থিতি সংঘটন হয়। অতএব দেখা যায়, বায়ু অপেক্ষা জলে ও জল অপেক্ষা ভূমিতে যে শব্দ-সঞ্চালন-শব্দ অধিক বলিয়া ইউরোপীয় পণ্ডিতগণ স্থির করিয়াছেন, প্রকৃতপক্ষে তাহা বিশুদ্ধ সত্য নহে। (এ স্থলে আবশ্যক যে, ভূমি-মধ্যে প্রোথিত ব্যক্তিদ্বয়ের সম্বন্ধে পূর্বোক্ত বিষয় সমাধি হইতে উত্থিত সন্ন্যাসী বা ফকিরদিগের নিকটে জানা যাইতে পারে।) তবে ইহা অবশ্য বক্তব্য যে, এক বায়ুর বা এক ভূতের মধ্যে থাকিয়াও পরস্পরের শব্দ-শ্রবণ বা অশ্রবণ সম্বন্ধে আরও অনেক কারণ আছে। যে স্থলে প্রতিকুল কারণ যত অধিক, তথায়ই তত বিলম্বে শব্দ শ্রুত হয়। এবং যে স্থলে অনুকূল কারণ যত অধিক তথায় তত শ্রীঘ্র আকর্ণিত হইয়া থাকে।


     ভারতবর্ষীয় মনীষিগণ আধ্যাত্মশক্তি-প্রভাবে বা সূক্ষ্ম দেহ-ধারণ দ্বারা এই সকল সূক্ষ্মতত্ত্বের আবিষ্কারে সমর্থ ছিলেন ও আছেন। একমাত্র বুদ্ধিবৃত্তির চালনা দ্বারা তাহার অন্যথা করা পৃথিবীস্থ কোন ব্যক্তিরই সাধ্য নহে। যদি কখনও সূক্ষ্ম দৃষ্টি স্থূল দৃষ্টির নিকটে পরাজিত হয়, যদি কখনও যোগী ভোগীর সমীপে অধ্যাত্ম-তত্ত্বে হিনতর বলিয়া সপ্রমাণ হয় এবং যদি কখনও ঈশ্বর-জ্ঞান বাহ্য জ্ঞানের নিকটে পরাভব প্রাপ্ত হয়, তথাপি ভারতীয় অতীন্দ্রিয়দর্শী মনস্বিগণের উদ্ভাবিত বিষয় কখনো মিথ্যা বলিয়া প্রকৃত রূপে প্রতিপন্ন হইবে না। তবে জ্ঞানহীনেরা চির-কালই জ্ঞানিগণের নিন্দা করিয়াছে ও করিবে, তাহাতে আর সন্দেহ নাই।

                - ঈশ্বর গুরুনাথ সেনগুপ্ত।
 ‌‌‌