ভক্তির সীমাবদ্ধ ভাব।




     প্রেম ও ভক্তির প্রভেদ

     ভক্তির পূর্ণতা হইলেই উহা প্রেমে পরিণত হয়। যেমন নদীর অন্তিম সীমা পাইলেই সাগর লাভ হয়, যেমন সীমাবদ্ধ কালের অন্তরে উপস্থিত হইলেই অনন্তকালে পতিত হইতে হয় এবং যেমন ইহলোক ত্যাগ করিলেই পরলোকে যাইতে হয়, তদ্রূপ ভক্তির অন্তিমভাগে উপনীত হইলে একমাত্র প্রেম ভিন্ন আর কিছুই জ্ঞানগোচর হয় না। যেমন সমুদ্রতীর প্রবাহিত নদী ও সমুদ্র এই উভয়ের মধ্যভাগস্থ ব্যক্তি নদী ও সমুদ্র উভয়ই এককালে লাভ করিতে পারেন, তদ্রূপ ভক্তি ও প্রেম একবারেই সাধিত হইতে পারে, কারণ পাত্র ভিন্ন হইলে উল্লিখিত গুণদ্বয়ের সাধনা এককালে হইবার বাধা নাই। পরন্তু এক পাত্রে পার্থিব ভক্তি ও প্রেমের সাধনা হইত পারে।




     প্রেম অসীম গুণ, ভক্তি ও গুণের সীমাবদ্ধ ভাব অর্থাৎ সময়ে প্রেম। সৃষ্ট আত্মার অসীম, সুতরাং প্রেমের ভাজনও অসীম, কিন্তু ভক্তির ভাজন অসীম নহে। কেননা সকলকেই ভয় করি না বা সমীহ করি না। বিশেষতঃ, যত উন্নতি হইতে থাকিবে, ততই ভক্তিভাজনের সংখ্যা অল্পতর হইবে এবং অবশেষে একমাত্র অনাদি পুরুষই ভক্তিভাজন থাকিবেন। কেননা প্রথমাবস্থায় যাঁহারা ভক্তিভাজন থাকেন, প্রেম দ্বারা তাঁহাদিগকেও প্রেমভাজন করিতে হয়। এ বিষয়ে প্রেমপ্রবন্ধে নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। যেমন প্রেমভাজনের সুখে সুখী, দুঃখে দুঃখ প্রভৃতি হয়, যেমন প্রেমভাজনের গুণানুবাদ শ্রবণ-কীর্ত্তন ইত্যাদি আত্মার সহজধর্ম্ম, তদ্রূপ ভক্তিভাজনেরও হয়। যদুক্তং মহাত্মানা- "শ্রবণং কীর্ত্তনং বিষ্ণোঃ স্মরণং
পাদসেবনং। অর্চ্চনং বন্দনং হাস্যাং সখ্যমাত্ম নিবেদনম্।" কিন্তু ভক্তির ভাজন অসীম নহে এবং ভক্তির (পার্থিব) লয় আছে, এজন্য উহাকে (ভক্তিকৈ) প্রেমের সীমাবদ্ধ ভাব বলা যাইতে পারে।




       প্রেমে "আমি ইহার, এ আমার" এইরূপ জ্ঞান সাক্ষাৎ সমন্ধে হয়, কিন্তু ভক্তিতে তদ্রূপ হয় না। ভক্তি হইলে পরিবর্তিতভাবে ঐ জ্ঞানের একাংশ মাত্র হয়, অর্থাৎ "আমি ইহাঁর" এইরূপ জ্ঞান মাত্র হয়। পরে।
   
     প্রেম "আমি ইহার, এ আমার" এইরূপ জ্ঞান সাক্ষাৎ সম্বন্ধে হয়। কিন্তু ভক্তিতে তদ্রূপ হয় না। ভক্তি হইলে পরিবর্ত্তিতভাবে ঐ জ্ঞানের একাংশ মাত্র হয়, অর্থাৎ "আমি ইহার" এইরূপ জ্ঞান মাত্র হয়। পরে ভাষার শক্তি ও বিচার দ্বারা পরম্পরা সম্বন্ধে শেষ অংশের জ্ঞানের (ইনি আমার এই বোধের) আভাস মাত্র আইসে।

       প্রেম হইলে প্রথমে "ইনি আমার" এই জ্ঞান হয় এবং পরিণামে অভেদ জ্ঞান হইলে, "ইনি আমি" এইরূপ হইয়া যায়। কিন্তু ভক্তি যতকাল থাকে, তাহার মধ্যে উহার একটীও বোধ হয় না ভক্তিভাজনের প্রতি)।



     যদিও প্রেমের প্রথমাবস্থায় প্রেমভাজনকে আপন অপেক্ষা উন্নত ভাবিলেও ভাবিতে পারে, কিন্তু পরিণামে "উন্নত বা অবনত" এইরূপ জ্ঞান বিলুপ্ত হ‌ইয়া "উভয়ে তুল্য ও উভয়ে এক "এই জ্ঞান উৎপন্ন হ‌ইয়া থাকে, কিন্তু ভক্তিতে তদ্রুপ নহে । ভক্তিভাজনকে চিরকাল (যতদিন তাঁহাকে প্রেমভাজন না করা যাইবে ) আপন অপেক্ষা উন্নত বোধ করিতে হয়। যদিও পিতা বা মাতা আপন অপেক্ষা অল্প গুণ বিশিষ্ট বা নিম্নশ্রেণীস্থ হন, তথাপি যতদিন তাঁহাদিগের প্রতি প্রেম করিতে না পারিবে, ততদিন পর্য্যন্ত তুমি তাঁহাদিগকে উন্নততর স্থানে স্থাপন করিতে বাধ্য। সুতরাং ভক্তিভাজন‌ মাত্রকেই  আপনপেক্ষা উন্নত ভাবিতে হ‌ইবে।

      প্রেমের ঋণ ক্রমে ক্রমে বর্দ্ধিত হয়, কিন্তু ভক্তির ঋণ ক্রমশঃ সঙ্কুচিত হয়।

     প্রেম দ্বারাই ঋণের উৎপত্তি ও বৃদ্ধি হয় এবং প্রেম দ্বারাই ঋণমুক্তি হয়, কিন্তু ভক্তি দ্বারা কেবল ঋণ বৃদ্ধিই হয়।


      প্রেমের ঋণ অপরিশোধ্য ও অসীম, কিন্তু ভক্তির ঋণ পরিশোধ্য ও পরিমেয়।

      যেমন কোন ব্যক্তির নিকটে ঋণ থাকিলে, তাহার ঋণ পরিশোধের উপযুক্ত দ্রব্য না রাখিয়া সমস্ত দ্রব্য‌ অপরসাৎ করিতে ন্যায়ানুসারে অধিকার থাকে না, তদ্রুপ প্রেমাস্পদকে আপনার সহিত না মিলাইয়া বা অভেদ জ্ঞান না করিয়া, অপরকে আত্মদান করা যাইতে পারে না। কিন্তু ভক্তি ভাজনের পক্ষে তদ্রুপ নহে, অর্থাৎ উঁহাকে ঐ রূপ মিলাইবার বা অভেদ জ্ঞান করিবার পূর্ব্বেই ঐ রূপ হ‌ইতে পারে।

                                                  -ঈশ্বর গুরুনাথ।