সাধনায় সুখ-দুঃখ।


 তত্ত্বজ্ঞান


দ্বিতীয় খণ্ড

সাধনা

প্রথম পরিচ্ছেদ

"সাধনা" এই মধুময় শব্দ কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইবামাত্র মনুষ্যমাত্রের, বিশেষতঃ, ধর্মার্থীর হৃদয়ে যে কি এক অপূর্ব্ব ভাব উদিত হয়, তাহা বর্ণনা করা সহজ নহে। সকলেই অবগত আছেন যে, অনেক পরম সুন্দর পদার্থের শোভা সুলেখকগণের বর্ণনায়ও অর্দ্ধ প্রকাশিত হয় না। হিমালয়ের শুভ্রবর্ণ শৃঙ্গসমূহে সূর্যকিরণ পতিত হইলে যে অনির্বচনীয় শোভা হয়, তাহা যতই উত্তমরূপে দর্শন-পূর্ব্বক বর্ণনা করা যাউক না কেন, কদাচ সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হইতে পারে না। যখন দৃশ্যমান পদার্থের বিষয়েই মানবাত্মা এতদূর শক্তিশূন্য, তখন যাহার কোনও কোনও অংশ ইন্দ্রিয়-গ্রাহ্য নহে এবং যাহা স্বয়ং কোনও জড়বস্তু নহে, এতাদৃশী মহতী সাধনার বর্ণনায় প্রবৃত্ত মানবগণ, বিশেষতঃ, মাদৃশ ক্ষুদ্র মনুষ্যগণ যে পূর্ণ-মনোরথ হইতে পারে, এরূপ সম্ভাবনা নাই। কিন্তু যাঁহার করুণায় অসম্ভব সম্ভব হয়, তাঁহার অসীম অনন্ত করুণার প্রতি নির্ভর করিয়া, একার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছি বলিয়াই নির্ভীক মনে লিখিতে প্রবৃত্ত হইলাম।

সাধনার মহিমা ভাষার অতীত, বাক্যের অতীত এবং চিন্তার অতীত। কেননা, এতদ্বিষয়ে যতই বলা যায়, ততই অধিকতর বক্তব্য প্রতীয়মান হয়, এবং যতই চিন্তা করা যায়, ততই প্রগাঢ় অনুসন্ধান-সাধ্য বহু বিষয় আসিয়া উপনীত হয়। "সাধনার” বলে আপাততঃ অসম্ভববৎ প্রতীয়মান কত শত ব্যাপার যে সুসিদ্ধ হইতে পারে, তাহার ইয়ত্তা নাই। জগতে আজ যে অত্যস্তৃত ব্যাপার-নিচয় অবলোকিত হইতেছে, অদ্য যে মনোহারিণী অট্টালিকায় বিলাস-পরায়ণ ধনশালিগণ সুখে বাস করিতেছেন, অদ্য যে উৎকৃষ্ট বস্ত্রসমূহ মানব নয়নের আকর্ষণ ও শীতাদি নিবারণের প্রশস্ত পথ পরিষ্কার করিতেছে, অদ্য যে (দুর্গম বরফময় প্রদেশে গমনাগমনের জন্য একচক্র শকট চালিত হইতেছে, অদ্য যে মাসগম্য স্থান-সমূহ দিবসগম্য হইয়া উঠিয়াছে, অদ্য যে তাড়িত বার্তাবহ-যোগে অতিদূরবর্তী স্থানের সংবাদ কতিপয় ঘন্টার মধ্যে প্রাপ্ত হওয়া যাইতেছে এবং অদ্য যে বহুশত যোজন-দূরবর্তী প্রদেশীয় বান্ধবের বাক্য যন্ত্রবিশেষ-যোগে আকর্ণিত হইয়া বিচ্ছেদ-ব্যথা নিবারিত করিতেছে, এ সকলই সাধনার ফল।) সাধনার বলে ভূতলবিহারী গগন ভ্রমণ করিতেছে, সাধনা-প্রভাবে ক্ষিতি বশীভূত হইয়া বাসনানুরূপ শস্য-সম্পত্তি প্রদান করে, দুর্গম পৰ্ব্বত হৃদয় বিদারণ করিয়া, গমন-পথ সাধককে দান করিতে বাধ্য হয়, ভীষণ হিংস্র শ্বাপদকুল-শঙ্কুল নিবিড় অরণ্যানী সুরম্য হর্ম্ম্য-বিভূষিত সুপ্রশস্ত রাজপথ-সুশোভিত মনোহর নগররূপে পরিণত হয়, এবং উন্নত পৰ্ব্বত সমভূমি ও সমভূমি পৰ্ব্বতবৎ অবস্থাপন্ন হয়, সাধনা-বলে জলনিধি উত্তাল তরঙ্গমালা-সঙ্কুল হইয়াও সাধক সমীপে সুস্থিরবৎ অবস্থান করে; বিদ্যুদ্বজ্র ক্রীতকিঙ্করবৎ কার্য্যসাধন করিয়া দেয়, আলোক সাধকের বাসনানুরূপ আকার ধারণ করে এবং সাধনায় বিশ্ব-বিনাশিনী প্রবল ঝটিকা বৃহৎ বৃক্ষাদি সমূলে উৎপাটিত, গ্রাম-নগরাদি বিপর্যস্ত ও সুদৃঢ় গৃহাদি সুকম্পিত করিয়াও সাধক-সকাশে আদেশ-পালক দাসের ন্যায় অবস্থিতি করিতে বাধ্য হয়। ফলতঃ, সাধনায় পঞ্চভূত বশীভূত, অশেষ দোষাকর ক্রোধাদি বিদূরিত, বিমল আনন্দদায়ক গুণ-নিচয় লব্ধ, হৃদয় প্রশান্তভাবে অবস্থিত এবং আত্মা আনন্দনীরধিনীরে নিমগ্ন হয়। সাধনার প্রভাব অধিক কি বলিব? দেখ, এই লোক ও পরলোকের মধ্যে যে অভেদ্যবৎ, অনুত্তার্য্যবৎ ও অনতিক্রম্যবৎ গমন-পরিপন্থী ভীষণ বিঘ্নময় প্রাচীর বিদ্যমান আছে, যাহা অতিক্রম করা দূরে থাকুক, যাহার পরপারের অস্তিত্ব বিষয়েও কতশত লোক সন্দিহান হইয়া রহিয়াছে, যাহা ভেদ করা দূরে থাকুক, সাধারণের পক্ষে তাহার অপর পার্শ্বের অস্তিত্ব কেবল অনুমিতি-সাধ্য এবং যাহার ঐ পার্শ্ব এত বিস্তীর্ণ যে, তাহার সহিত তুলনা করিলে এই ক্ষুদ্রতম ভূলোক পরমাণুবৎ প্রতীয়মান হয়, সাধনাবলে তাহার যাবতীয় বৃত্তান্ত সূক্ষ্মানুসূক্ষ্ম রূপে পরিজ্ঞাত হওয়া যায় এবং ঐ দুর্ভেদ্য, দুস্তর ও দুরতিক্রম্য প্রাচীর আপনা হইতেই সমভূমিবৎ হইয়া যাওয়াতে, সমুদায় প্রদেশ সাধকের বিশুদ্ধ সূক্ষ্মদর্শনক্ষম ও সর্ব্ববিঘ্নাতিক্রমে সমর্থ নয়নের বিষয়ীভূত হয়। সাধনাপ্রভাবে সৃষ্টিকর্তার একমাত্র দৃষ্ট এবং সৃষ্টজীবের একান্ত দুর্বোধ ও অনুমিতির অতীত সৃষ্টিবৃত্তান্ত সাধকের হৃদয়ালেখ্যে চিত্রিত হয়। সাধনা-প্রভাবে সৃষ্টিকাণ্ডের বর্ণনা অনুমান জন্য শত শত প্রকারে বহুতর দেশে যে বর্ণিত হইয়াছে, তাহার একীভাব সুসম্পন্ন হয়, সাধনার মহীয়সী শক্তি হেতু জীবাত্মার পুনঃ পুনরাবৃত্তি বা একমাত্র গতি অর্থাৎ একাধিক জন্ম বা একবার মাত্র জন্ম ইত্যাদি পরস্পর বিরুদ্ধবৎ মত সকল মীমাংসিত হয়। অথবা, সাধনা-প্রভাবে অজাত-শত্রু হইয়া জগদ্বাসীর প্রত্যেককে সানন্দে ও প্রেমবন্ধে গ্রহণ করা যায় এবং স্বীয় বিপরীত বাদীর প্রতিও প্রেমবৃদ্ধি হইতে থাকে। অপিচ, সাধনার বলে মানব পার্থিব-উপায়-বিশেষ-অবলম্বন না করিয়াও সশরীরে পৃথিবীর মধ্যে যথা ইচ্ছা তথায় গমন করিতে পারে, সাধনার বলে ইচ্ছানুসারে দেহ হইতে বহির্গত হইয়া ইহলোকে ভ্রমণ ও পরলোকে গমন-পূর্ব্বক পৃথিবীর কোটি কোটি গুণ-স্থান সমূহে পৃথিবী অপেক্ষা অত্যাশ্চর্য্য অনির্বচনীয় ভাব-লহরী অবলোকন করায়, বিশ্ব জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-পালন-কর্তার প্রতি অতুল প্রেমভাব সমুৎপন্ন হয় এবং তাহাতে প্রেমিকের প্রেমময় হৃদয় মনুষ্য-সুলভ ক্ষুদ্রত্ব বিবর্জিত হয়। সাধারণ লোকে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য বা হিন্দু, মুসলমান, খৃষ্টান প্রভৃতি জাতিভেদ লইয়াই অস্থির হইয়া পড়ে, কিন্তু মহাত্মা সাধকগণ স্বকীয় মহীয়সী সাধনায় মানব-জাতির প্রতি ভেদজ্ঞানের কথা দূরে যাউক, পশুত্ব পক্ষিত্বাদি জাতিভেদ পর্যন্ত আপনার বিশাল হৃদয় হইতে বিদূরিত করিয়া দেন এবং অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডে একটি অনন্ত চৈতন্যানন্দের স্রোত প্রবাহিত দেখিয়া অনন্ত আনন্দে নিমগ্ন হন। তাঁহারা যদিও ইহা পরিজ্ঞাত আছেন যে, বীজের যেরূপ উৎপাদক বৃক্ষাকারে পরিণতি সম্ভবপর, জীবের তদ্রুপ বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের মূল কারণে লীনতা স্ব-সাধ্য নহে, তথাপি "একমেবাদ্বিতীয়ম্” অর্থাৎ 'একভিন্ন দ্বিতীয় নাই' এই মহৎ জ্ঞানের উন্নত পরিণতি প্রযুক্ত সর্ব্বত্র ব্রহ্মাণ্ডেশ্বরের পরম সত্তা অনুভব করিয়া সতত তাঁহার প্রেম-অঙ্কে উঠিয়া প্রেমানন্দে প্রেমমুখনিঃসৃত তদীয় প্রেমসুধা পান করিতে থাকেন। অহো! এইরূপ অবস্থা লাভ করার ত কথাই নাই, ইহার স্মরণই বা কি অতুল আনন্দদায়ক, অবিনাশ্য আশার সঞ্চারক ও অনুপম নির্ভরতা সম্পাদক!

                            তত্ত্বজ্ঞান দ্বিতীয় খন্ড সাধনা।
                             --- ঈশ্বর গুরুনাথ সেনগুপ্ত।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ