সত্যধর্মের সত্যতা ও সর্বশ্রেষ্ঠতা
(ক) সাকার উপাসনা— পরমপিতা জড় জগতের সহিত তাঁহার অংশ সংযুক্ত করিয়াছেন, কিন্তু তিনি ঐ সৃষ্টি হইতে নির্লিপ্তভাবে বিভিন্ন আছেন, সুতরাং আকার-বিশিষ্ট যাহাই ধর না কেন, তাহাই জড় জগতের সহিত সংযুক্ত হইবেই হইবে। এজন্য উহা কখনই সেই অনন্তশক্তি অনাদি অনন্ত নহে। অতএব আকার বিশিষ্ট বা সাকারের উপাসনা করিলে কখনই পরমপিতা পরমেশ্বরের উপাসনা করা হয় না। এ নিমিত্ত সহজেই সপ্রমাণ হইতেছে যে, সাকার উপাসনা কর্ত্তব্য নহে।
হিন্দুধর্ম্মের শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব প্রভৃতি মতে সাকার উপাসনার বিধি আছে । কিন্তু ঐ সকল মাতালম্বীরাও ইহা স্বীকার করেন যে, পরমাত্মা সাকার নহেন। পরন্ত "সাধকানাং হিতার্থায় ব্রহ্মণোরূপকল্পনা" অর্থাৎ সাধকদিগের হিতের নিমিত্ত ব্রহ্মের—নিরাকার পরমত্মার রূপ কল্পনা করা হয় । তাঁহারা বলেন, নিরাকারভাব সকলে ধারণা করিতে পারে না,
এজন্য নিকৃষ্ট-চেতা উপাসকদিগের হিতের নিমিত্তই সেই নিরাকার পরম ব্রহ্মেরও রূপ কল্পিত হইল। কিন্তু যাহা কল্পনা, তাহা যে সত্য নহে, ইহা বলা বাহুল্য। আরও দেখ, তাঁহাদিগের এক প্রধান ভ্রম এই যে, তাঁহার বলেন —"প্রথমে সাকার দেবদেবীর উপাসনা করিলে জ্ঞানযোগ হয়, সেই জ্ঞানযোগ ব্যতীত মনুষ্য কখনও নিরাকার ব্রক্ষকে ধারনা করিতে পারে না ।"
(খ) কি হঠযোগ, কি রাজযোগ, কি অন্যবিধ যোগ, সকলেরই উদ্দেশ্য চিত্তের একাগ্ৰতা-সাধন। যখন পরমপিতার প্রতি প্রেম করিতে পারিলেই আত্মার একাগ্ৰতা জন্মে, তখন ঐ বিষয়ের যে কোনও প্রয়োজন নাই, তাহা অনায়াসেই হৃদরঙ্গম হইতেছে । কেননা শতবর্ষ যোগসাধন করিয়া যেরূপ একাগ্ৰতা হয়, এক মুহূর্ত্তের প্রেমে তদপেক্ষা সহস্র গুণে একাগ্ৰতা জন্মে। আরও দেখ, শেষোক্ত উপায়ে কার্য্য করিলে একাগ্ৰতা ব্যতীত পাপমুক্তি প্রভৃতি লাভও হয় ।
(গ) কতকগুলি লোক আসনসিদ্ধি প্রভৃতি বিষয়ে ব্যাপৃত থাকেন, কিন্তু উহারও আব্শ্যকতা নাই, কারণ উহাও যোগেরই অন্তর্গত। দেখ, অমূল্যরত্ন হীরকমণি-মাণিক্যাদি লাভে যেমন সামান্য অর্থের অভাব থাকে না, তদ্রূপ সতধর্ম্ম লাভ হইলে আর ঐ সকলের কোনও প্রয়োজন থাকিবে না ।
(ঘ) নিরাকারবাদপূর্ণ বেদান্ত প্রতিপাদ্য ধর্ম্ম অপেক্ষাও সত্যধর্ম্ম শ্রেষ্ঠ ও সত্য, কেননা বেদান্তে ব্রহ্মকে নিরাকার স্বীকার করিলেও "তত্ত্বমসি", "সোহঽং" প্রভৃতি ঘোরতর অহংকারময় অন্যায্য বাক্য থাকাতে ও উপাসনার প্রকৃষ্ট পদ্ধতি না থাকাতে উহা অসত্য ও সত্যস্বরূপ লাভের অনুপযুক্ত। থিয়জফিষ্ট ও যোগসাধকেরাও "সোহঽং" মতাবলম্বী। সুতরাং ঐ ভয়ানক মতের খন্ডনার্থে কিঞ্চিৎ লিখিত হইল ।
হে ক্ষুদ্র! হে ক্ষুদ্র হইতেও ক্ষুদ্র মানব! তুমি যখন অপর এক বা একাধিক মানবকে আত্মতুল্য জ্ঞান করিতে পার না, তখন সেই অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডেশ্বরকে কিরূপে আত্মতুল্য বোধ করিবে ? হে ক্ষুদ্রতম প্রস্তরকণা ! তুমি কিরূপে ও কোন্ সাহসে অনন্ত হিমাচলকে আত্মসদৃশ বিবেচনা করিবে? হে ক্ষুদ্র মানব ! যখন তুমি তোমা অপেক্ষা কিঞ্চিৎ উন্নত কোনও আত্মাকে কস্মিন্-কালে আত্মাতুল্যবোধে সমর্থ নহ, তখন তোমা অপেক্ষা অনন্তগুণে উন্নত পরমপিতাকে কিরূপে আত্মতুল্য বলিয়া নির্দ্দেশ করিতে সাহস কর ?
মনুষ্য যতই উন্নত হউক, কখনও পরম পিতার লীন হয় না। যেমন বৃত্তক্ষেত্র মধ্যে যত প্রকার নিয়মিত সরল রৈখিক ক্ষেত্র থাকিতে পারে, তন্মধ্যে নিয়মিত ত্রিভুজ ক্ষেত্র অল্পসংখ্যক বাহুবিশিষ্ট ও অল্পস্থানব্যাপী, তদ্রপ পরমপিতার সৃষ্টিতে যত প্রকার পর্দাথ আছে, তন্মধ্যে তোমাদিগের দৃশ্যমান এই স্থূলজগৎ পরলোক অপেক্ষা অল্পতর গুণবিশিষ্ট অর্থাৎ দৈর্ঘ্য, বিস্তার ও বেধ এই ত্রিবিধ গুণযুক্ত।
যেমন বৃত্তমধ্যস্থ সমচতুর্ভুজ, সমপঞ্চভুজ, সমষড়ভুজ, সমশতভূজ প্রভৃতি ক্ষেত্র ক্রমশঃ উক্ত ত্রিভুজ অপেক্ষা অধিক বাহুবিশিষ্ট ও অধিক স্থানব্যাপী, সুতরাং বৃত্তের অপেক্ষাকৃত নিকটবর্ত্তী, তদ্রপ পারলৌকিক উন্নত আত্মাদিগের দেহও (পারলৌকিক আত্মাদিগেরও দেহ আছে, উহা অপেক্ষাকৃত সূক্ষ্ম এইমাত্র প্রভেদ।
এই বিষয় ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে বর্ণিত হইবে।) চারি, পাঁচ, ছয়, সাত, শত ইত্যাদি সংখ্যক গুণবিশিষ্ট এবং তাঁহারা তোমাদিগের অপেক্ষা অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন ও পরমপিতার অধিক নিকটবর্ত্তী। কিন্তু যেমন বৃহত্তমধ্যস্থিত নিয়মিত সরল রৈখিক ক্ষেত্রের বাহুসংখ্যা যতই বর্দ্ধিত হউক না কেন, উহা কখনই বৃত্তের সমান হইতে পারে না, তদ্রূপ জীবাত্মাও যতই উন্নতি লাভ করুক না কেন, কখনই পরমপিতার তুল্য হইতে পারে না ।
এক্ষণে বিবেচনা করিয়া দেখ, যদি নিব্বাণ না হইল, অর্থাৎ যদি জীবাত্মা কখনও পরমাত্মার তুল্য হইতে না পারিল, প্রত্যুত অনন্তকাল অনন্ত ক্ষুদ্রভাবে তাঁহার নিকটে রহিল তবে কখনও সে পরমাত্মাতে লীন হইতে পারিবে না।
(ঙ) থিয়জফিষ্ট ধর্ম্মে যদিও গুণের উন্নতির বিধি আছে, কিন্তু উহাও "সোহঽং" এই অসীম অহংকার-পূর্ণ অন্যায্যভাবে— মলিনভাবে কলুষিত এবং উপাসনা প্রভৃতির প্রকৃষ্ট উপায় না থাকাতে হীনতর ।
(চ) বৌদ্ধধর্ম্ম প্রধানতঃ তিন ভাগে বিভক্ত । এক ভাগ নিরীশ্বরবাদপূর্ণ, ২য় ভাগ লামা প্রভৃতির অর্চ্চনার নিমিত্ত পৌত্তলিক ধর্ম্ম-সদৃশ এবং ৩য় ভাগ পরলোক ও পারলৌকিক আত্মাদিগের অস্বীকারপূর্ব্বক কেবল নির্ব্বাণ লাভার্থে চিৎকারপূর্ণ। সুতরাং বৌদ্ধধর্ম্ম সত্য নহে। কারণ উহার প্রথম ভাগের বিষয়ে অধিক তর্কের প্রয়োজন নাই, মনুষ্য-মাত্রেরই যে সহজজ্ঞান আছে,
উহা তাহার বিরোধী, সুতরাং ভ্রান্ত। ২য় ভাগ যে অসত্য, তাহা পৌত্তলিক ধর্ম্মের অসত্যতা বিষয়ে যাহা লিখিত হইয়াছে তাহাতেই উপলব্ধ হইবে। এবং ৩য় ভাগের মূল মতই যে অসত্য, তাহা ইতঃপূর্ব্বে বেদান্ত-ধর্ম্মের অসত্যতা প্রতিপাদন সময়ে প্রদর্শিত হইয়াছে। অতএব বৌদ্ধধর্ম্মের সমস্ত মতই যে অসত্য, তাহা প্রতিপন্ন হইল। "সমস্ত মতই যে অসত্য" একথা বলাতে কেহই যেন এরূপ ভাবেন না যে, বৌদ্ধধর্ম্মে "অহিংসা পরমোধর্ম্মঃ" ইত্যাদি নীতি-বিষয়ক যে সকল উপদেশ আছে, তাহাও অসত্য।
বত্ততঃ কোনও ধর্ম্মের সমস্ত মত অসত্য নহে (বিশেষতঃ নীতিবিষয়ক)। তবে যে ভিত্তির উপরে ঐ মত গ্ৰথিত থাকে, অথবা যাহা ঐ ধর্ম্মের প্রধান বিষয়, তাহা সমস্ত বা ব্যস্তভাবে অসত্য হইলেই ঐ ধর্ম্মকে অসত্য বলা যায়। এস্থলে ইহা বলা আবশ্যক যে, বুদ্ধদেব যে অভিপ্রায়ে এই ধর্ম্ম প্রচার করিয়াছিলেন, ভবিষ্যতের লোকেরা সেই অভিপ্রায় ভুলিয়া নুতন মত চালাইয়াছে।
(ছ) খ্রিষ্টীয়-ধর্ম্ম ।—এই ধর্ম্মে পরমপিতার সহিত পুত্র ও পবিত্র আত্মার অভেদ-ভাব কল্পিত হইয়াছে । কিন্তু ইতঃপূর্ব্বে প্রদর্শিত হইয়াছে যে, তাহা কখনও হইতে পারে না । অপর, এই ধর্ম্মে সূক্ষ্ম-জ্ঞানের বিষয় কিছুই উল্লিখিত নাই, এই দুই কারণবশতঃ প্রচলিত খ্রিষ্টীয়-ধর্ম্ম ঐকদেশিক।
(জ) মহম্মদীয়-ধর্ম্ম ।—এই ধর্ম্মেও খ্রিষ্টীয় ধর্ম্মের ন্যায় ঐকদেশিকতা দৃষ্ট হয়, অধিকন্তু বিধম্মীদিগের প্রাণনাশে ধর্ম্মলাভ প্রভৃতি কতকগুলি আসুরিক নিয়মও প্রচলিত আছে, সুতরাং ইহাকে সত্য বলা যায় না।
(ঝ) ব্রাহ্ম-ধর্ম্ম ।— এই ধর্ম্মে পৌত্তলিকতা নাই, ইহাই ইহার একমাত্র গুণ পরন্তু ইহাতে প্রকৃত উপাসনার পদ্ধতি প্রচলিত নাই এবং এই ধর্ম্মাবলম্মিগণ প্রকৃত উপাসনার অভাবে সূক্ষ্ম জগতের কোনও বিষয় জানিতে পারেন না এবং জড়জগতের সূক্ষ্মবিষয় পরিজ্ঞানেও অসমর্থ। তজ্জন্যই ইঁহারা পুনর্জন্মাদি স্বীকার করেন না । আর, যে গুরু না হইলে আমরা কিছুই জানিতে পারি না, ইঁহারা ধর্ম্মশিক্ষার্থে সেই গুরুস্বীকার করেন না। এজন্য ইহাও ঐকদেশিক ধর্ম্ম, প্রকৃত ধর্ম্ম নহে।
(ঞ) স্পিরিচুয়ালিষ্ট-ধর্ম্ম। —অর্থাৎ বর্ত্তমান সময়ে আমেরিকা প্রভৃতি স্থানে যে আত্মাকর্ষণের বিষয় প্রকাশিত আছে, তৎসংক্রান্ত সকল বিষয়ও সম্পূর্ণ সত্য নহে, কারণ তাঁহার অত্যুন্নত মহাত্মাদিগের উপদেশ না পাওয়াতে প্রকৃত জ্ঞানের —প্রকৃত ধর্ম্মের বিষয়ে সবিশেষ জানিতে পারেন নাই। এজন্যই তাঁহাদিগের গ্ৰন্থে কোন গূঢ় উপদেশ নাই। এজন্য উহাও সম্পূর্ণ সত্য নহে, ঐকদেশিক ধর্ম্ম।
উপরিভাগে প্রচলিত ধর্ম্মসমূহের অসত্যতা ও ঐকদেশিকতা প্রদর্শনকালে ইহাও প্রদর্শিত হইয়াছে যে সতধর্ম্ম উহাদিগের কোনওটীর ন্যায় ঐকদেশিক নহে এবং ঐ সকল ধর্ম্মসম্বন্ধে যে সকল ভ্রান্তি আছে, তাহাও ইহাতে নাই, সুতরাং ইহা সত্য।
সত্যধর্ম্ম যে ঐকদেশিক নহে, প্রত্যুত সর্ব্বাঙ্গবিশুদ্ধ ও অপর সমস্ত ধর্ম্ম অপেক্ষা ব্যাপক, তাহার প্রমাণ এহ—
১। অন্যান্য ধর্ম্ম পৃথিবীর মধ্যে যে সকল ভাব আছে, কেবল তাহাতেই বদ্ধ। কিন্তু সত্যধর্ম্ম অসীমভাবে বিস্তৃত। ইহা পৃথিবীকে অতি তুচ্ছ বোধ করে এবং ইহা পরলোক ও পারলৌকিক আত্মা ইত্যাদি বিষয়ের আলোচনা প্রধান। দেখ, হিন্দুধর্ম্মাদিতে যে অষ্ট-সিদ্ধির উল্লেখ আছে, তাহা পৃথিবীমধ্যস্থ, কিন্তু সতধর্ম্ম ব্যতীত অপর কোনও ধর্ম্মে ইহলোকস্থ হইয়াও পরলোকে গমন ও তথাকার বিষয় পরিজ্ঞানরূপ মহত্ত্ব নাই।
২। অন্যান্য ধর্ম্ম পৃথিবী পরিত্যাগ করিয়া অন্ধবৎ আর কিছু দেখিতে না পাইয়া একেবারে নির্ব্বাণ নির্ব্বাণ করিয়া চিৎকার করে, কিন্তু সতধর্ম্ম তদ্রূপ নহে। উহা পরমপিতার ক্রমময়-সৃষ্টির ন্যায় ক্রমে ক্রমে অসীম জ্ঞানমার্গ প্রদর্শক ও ক্রমশঃ উন্নতির দিকে অমীমরূপে প্রসারিত।
৩। অন্যান্য ধর্ম্মে সমস্ত জ্ঞাতব্যবিষয় পরিজ্ঞাত হওয়া যায় না। উহাদিগের মধ্যে কোন কোনটী পুরাতত্ত্বের, কোন কোনটী জ্যোতিষশাস্ত্রের এবং কোন কোনটী বিজ্ঞান-শাস্ত্রের বিরুদ্ধ ও অসংলগ্ন। কিন্তু সতধর্ম্ম তদ্রূপ নহে। উহাতে সমস্ত শাস্ত্রের ও সমস্ত জ্ঞাতব্য বিষয়ের সুচারু মীমাংসা আছে।
৪। অন্যান্য ধর্ম্মে যে সকল আশ্চর্য্য ঘটনার বিষয় আছে, এই ধর্ম্মে তৎসমুদয়ই আছে, কিন্তু ইহাতে যে সকল অত্যাশ্চর্য্য ঘটনার বিষয় আছে, অন্য কোনও ধর্ম্মে তাহা নাই। কপিলের শাপে সগরপুত্রগণের বিনাশ, ভগীরথের অদ্ভুত উৎপত্তি ও অস্থিপ্রাপ্তি এবং গঙ্গার আনয়নদ্বারা সগরপুত্রদিগের উদ্ধার প্রভৃতি যে সকল কথা হিন্দুধর্ম্মে আছে এবং ৫-খানি রুটিদ্বারা বহু লোকের ভোজনসম্পাদন এবং ভুক্তাবশিষ্ট রুটির সংখ্যা শতাধিক গণনা ইত্যাদি যে সকল কথা খ্রিষ্টীয় ধর্ম্মে আছে, একমাত্র সত্যধর্ম্মে তৎসমুদায়ের মীমাংসা আছে । (বাকসিদ্ধি প্রকরণ দেখ) । কিন্তু অন্য কোনও ধর্ম্মে ঐরূপ সামঞ্জস্য নাই ইত্যাদি ।
৫। অন্যান্য ধর্ম্ম ক্রমশূন্য ও একদেশদর্শী, কিন্তু সত্যধর্ম্ম ক্রমপূর্ণ ও সর্ব্বদর্শী। খ্রীষ্টীয় ধর্ম্মাদিতে পাপমুক্তির অন্তিম ফল, কিন্তু তাহাও যে কি উপায়ে হইতে পারে, তাহাও বিশেষ বিবরণ নাই । যোগসাধনধর্ম্ম ও বৌদ্ধধর্ম্মের মতে পাপ ও পূণ্যই নাই, অথচ ঐ দুইটি ধর্ম্ম নির্ব্বাণ এই ভীষন চিৎকাররবে মিশ্রিত, সুতরাং উন্নতিলাভের জন্য উহারা কতিপয় শুষ্ক জ্ঞানের উপর মাত্র নির্ভর করে। আত্মাকর্ষণ,
পাপগ্ৰহণ, বিবিধ সিদ্ধিলাভ ও আয়ুঃপ্রদানশক্তি এই সকল প্রধান বিষয়ের যথাযথ বিবরণ সত্যধর্ম্ম ভিন্ন অন্য কোনও ধর্ম্মে নাই। খৃষ্টান ধর্ম্মে একমাত্র পাপগ্ৰহণের কিছু উল্লেখ আছে বটে, কিন্তু তাহাও অন্যের কিরূপে হয়, তাহা নাই। হিন্দুধর্ম্মে একমাত্র সিদ্ধির কথা আছে বটে, কিন্তু তাহাও পূর্ব্বানুরূপ স্থূলভাবে বদ্ধ। অন্যান্য প্রচলিত ধর্ম্মে এ বিষয়ের কিছূই নাই, বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। সুতরাং এই সকল বিষয় হইতে জানা যাইতেছে যে সত্যধর্ম্মই একমাত্র সত্য ও সর্ব্বোৎকৃষ্ট।
পূর্ব্বেই উল্লিখিত হইয়াছে যে, পারলৌকিক মহাত্মাদিগের নিকট হইতে আমরা এই ধর্ম্ম প্রাপ্ত হইয়াছি। সুতরাং তাঁহারাই এই ধর্ম্মের প্রচারক।
যে ব্যক্তির (১) প্রেম, (২) সরলতা, (৩) পবিত্রতা, (৪) একাগ্ৰতা, (৫) ভক্তি ও ঈশ্বরজ্ঞান আছে এবং (৬) যাহার মন কুপথে গমন করে না, পারলৌকিক আত্মারা তাঁহাকে আশ্রয় করিতে ও স্ব স্ব মন্তত্য জানাইতে পারেন। কিন্তু কেবল উক্ত গুণগুলি থাকিলেই পারলৌকিক মহাত্মারা কোনও ব্যক্তির দেহ আশ্রয় করেন না। যে ব্যক্তির উল্লিখিত গুণসমূহ অত্যন্ত অধিক পরিমাণে হইয়াছে এবং নিম্নলিখিত গুণগুলিও আছে, পারলৌকিক মহাত্মারা তাঁহাকেই আশ্রয় করিয়া থাকেন ।
গুণ যথা—
(৭) সম্পত্তি বিষয়ে নিম্পৃহতা ।
(৮) নিষ্পাপ অবস্থা বা মূর্ত্তিমতী পবিত্রতা।
(৯) অন্যদীয় পাপগ্ৰহণ ক্ষমতা ।
(১০) লোকের উপকার ভিন্ন অপকার করিব না, এই বিষয়ে দৃঢ় - নিশ্চয়তা ।
(১১) সিদ্ধিসমূহ লাভের উপযুক্ত গুণ।
(১২) কাম-ক্রোধহীনতা।
(১৩) অন্ততঃ সমস্ত মনুষ্যকে সহোদরবৎ দর্শন ও তদনুরূপ আচরণ করা । ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি ।
এক্ষণে বিবেচনা করিয়া দেখ, তোমাদিগের জ্ঞাতব্যবিষয়ে পারলৌকিক মহাত্মারা যাহা জ্ঞাত আছেন, তাহা অবশ্যই অভ্রান্ত, কেননা তাঁহারা ঈশ্বরের এত সান্নিধ্যলাভ করিয়াছেন যে, এই বিষয়ে তাঁহাদিগের হৃদয়ে আর ভ্রান্তি যাইতে পারে না। সুতরাং সহজেই প্রতীয়মান হইবে যে, অন্ধজগৎ আপনার আত্মার উৎকর্ষে যাহা জানিয়াছে, তাহা অপেক্ষা, —পারলৌকিক মহাত্মাদিগের দ্বারা যাহা জানা যাইতেছে, তাহা সত্য, সত্য, !!! সুতরাং সত্যধর্ম্ম যে প্রকৃতপক্ষে সর্ব্বাঙ্গবিশুদ্ধ ও সত্য, তদ্বিষযে আর কোনও সন্দেহ নাই !!!
ওঁং
— সত্যধর্ম্ম প্রথম পরিচ্ছেদ।

0 মন্তব্যসমূহ