উপাসনার দ্বিতীয় অংশ স্বীয় পাপকথন।
উপাসনাকালে স্বীয় পাপের যে, কেন উল্লেখ করিতে হয়, ইহা চিন্তাশীল সরলচিত্ত মনস্বী মানবকে বুঝাইতে হয় না। কিন্তু আজকাল যেরূপ কূট তর্ক রাশির অধিকার লক্ষিত হয়, তাহাতে এবিষয়ের কিঞ্চিৎ বর্ণনা না করিলে, অধিকাংশ লোকেই এ গ্রন্থের প্রতি সাদর দৃষ্টিপাত করিবেন না। এজন্যই এবিষয়ে যৎকিঞ্চিৎ লিখিত হইল।
দেখ মানবের দেহাবচ্ছিন্ন অবস্থায় উহার তিনটি অংশ লক্ষিত হয়। ১ম আত্মা, ২ম মনঃ এবং তৃতীয় শরীর। কোনও পাপ করিলে যদি শারীরিক পীড়া উপস্থিত হয়, তবে যেমন ঐ পীড়ার কারণ উল্লেখ - পূর্বক চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা আবশ্যক, তদ্ধপ মনে বা জীবাত্মায় (পাশবদ্ধ আত্নায়) কোনও ক্লেশ উপস্থিত হইলে, তাহারও কারণ প্রকাশ করা-সম্পূর্ণরূপে উল্লেখ করা অত্যাবশ্যক।
যখনই তোমার আধি ব্যাধি জন্য যাতনা অনুভব হইবে, তখনই তুমি কিছু না কিছু পাপের উল্লেখ করিয়া থাক। তখন অন্ততঃ অন্যের অজ্ঞাতসারেও স্বীয় পাপের জন্য অনুতাপ প্রকাশ কর। অতদূর স্বীয় পাপের উল্লেখ করা যে, মানব হৃদয়ের স্বাভাবিক ধর্ম ও পাপমুক্তির প্রধান উপায়, তদ্বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই।
যখনই তোমার আধি ব্যাধি জন্য যাতনা অনুভব হইবে, তখনই তুমি কিছু না কিছু পাপের উল্লেখ করিয়া থাক। তখন অন্ততঃ অন্যের অজ্ঞাতসারেও স্বীয় পাপের জন্য অনুতাপ প্রকাশ কর। অতদূর স্বীয় পাপের উল্লেখ করা যে, মানব হৃদয়ের স্বাভাবিক ধর্ম ও পাপমুক্তির প্রধান উপায়, তদ্বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই।
যেমন রোগের জন্য রোগমুক্তি-দাতা চিকিৎসকের নিকটে স্বপাপের উল্লেখ আবশ্যক, তদ্বপ, সর্ব্ববিধ পাপের জন্য সর্ব্বপাপমুক্তিদাতা পরমপিতার নিকটে স্বপাপোক্তি করা কর্ত্তব্য। প্রথমোক্ত স্থলে অসর্ব্বজ্ঞ চিকিৎসক মহাশয়ের পরিজ্ঞানার্থে পাপোক্তি আবশ্যক। কিন্তু শোষোক্ত স্থলে সে কারণ-বশতঃ নহে জগদীশ্বরের নিকটে স্বীয় পাপরাশির উল্লেখ করিলে,
উহার মূল্য তখনই শিথিল হয় এবং তৎপরে দোষলেশ-শূন্য অনন্ত গুণ-নিধির পুত্র হইয়া এইরূপ পাপচরণ করিয়াছি-চিন্তা করিবামাত্র ভীষন আত্মগ্লানি উপস্থিত হয় এবং সেই আত্মগ্লানি প্রভাবেই পাপরাশি বিদূরিত হইয়া যায়। তখন আর মানস ক্ষেত্র পাপরূপ পঙ্কিল জলে কর্দমাক্ত থাকে না, তখন পাপের বিগমে আত্মপ্রসাদ-সুধা সহজেই লব্ধ হইয়া থাকে।
উহার মূল্য তখনই শিথিল হয় এবং তৎপরে দোষলেশ-শূন্য অনন্ত গুণ-নিধির পুত্র হইয়া এইরূপ পাপচরণ করিয়াছি-চিন্তা করিবামাত্র ভীষন আত্মগ্লানি উপস্থিত হয় এবং সেই আত্মগ্লানি প্রভাবেই পাপরাশি বিদূরিত হইয়া যায়। তখন আর মানস ক্ষেত্র পাপরূপ পঙ্কিল জলে কর্দমাক্ত থাকে না, তখন পাপের বিগমে আত্মপ্রসাদ-সুধা সহজেই লব্ধ হইয়া থাকে।
স্বপাপোক্তি বা স্বীয় পাপের খ্যাপন যে, পাপমুক্তির একটি প্রধান উপায় ইহা অস্মদ্দেশীয় মহাত্মা মনুও লিখিয়া গিয়াছেন। যথা-
খ্যাপনেনানুতাপেন, তপসাহধ্যয়নেনচ।
পাপকৃন্মুচ্যতে পাপাৎ তথা দানেন চাপদি।।
অর্থাৎ খ্যাপন অর্থাৎ স্বীয়-পাপোক্তি এবং তজ্জন্য অনুতাপ, আর তপস্যা ও ধর্ম্মশাস্ত্রের অধ্যায়ন এবং আপৎকালে দান -- এই সকল কর্ম্মদ্বারা পাপকারী মানব পাপ হইতে মুক্ত হইয়া থাকে। এক্ষণে জিজ্ঞাস্য হইতে পারে যে, তপস্যা কি? এ বিষয়েও মনু যাহা বলিয়াছেন, তাহা এই--
ব্রাহ্মণস্য তপো জ্ঞানং, তপঃ ক্ষত্রস্য রক্ষণম্।
বৈশ্যস্য তু তপো বার্ত্তা, তপঃ শূদ্রস্য সেবনম্।।
অর্থাৎ ব্রাহ্মণের পক্ষে জ্ঞান-তত্ত্বজ্ঞানই তপঃ, ক্ষত্রিয়ের রক্ষাকার্য্যই তপস্যা, বৈশ্যের বার্ত্তাই (কৃষিবাণিজ্য - পশুপালনাদিই ) তপস্যা এবং শূদ্র্যোর পক্ষে দ্বিজাতির সেবাই তপস্যা। এতদ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হইতেছে যে, যাহার যতদূর সাধ্য, সে ততদূর কার্য্য করিলেই তাহার তপস্যা করা হইল।
যাঁহারা একমাত্র জ্ঞান-পথের পথিক, তাঁহাদিগের পক্ষে তত্ত্বজ্ঞানই তপস্যা। তৎপর যাঁহারা কেবল জ্ঞান লইয়াই সময় যাপন করেন না, প্রত্যুত জ্ঞান-মার্গাবলম্বীদিগের ও অন্যান্য বহুলোকের রক্ষাকার্য্যে নিযুক্ত থাকিয়া স্বদেশকে বিঘ্নবিপত্তি হইতে রক্ষা করেন, তাদৃশ্য সম্প্রদায়ী দিগের পক্ষে রক্ষণই তপঃ বলিয়া কথিত হয়। আর যাহারা পূর্বোক্ত সম্প্রদায়দ্বয়ের অন্তগত নহেন, কৃষি, ব্যাণিজ্য, পশুপালনাদি দ্বারা সমাজের একটি প্রধান অভাব দূর করেন, তাদৃশ শিক্ষিত শ্রেণীর পক্ষে বাত্তাই তপস্যা। আর যাহারানিতান্ত অজ্ঞান,
পূর্ব্বোক্ত ত্রিবিধ কার্য্যের মধ্যে কোনও কার্য্যেই সমর্থ নহে, তাহারা উক্ত শ্রেণীত্রয়ের সেবা দ্বারা সমাজের বহু অভাব দূর করিয়া থাকে। এই শ্রেণীর পক্ষে প্রথামোক্ত শ্রেণীত্রয়ের সেবাই তপস্যা যাহা হউক এ পর্য্যন্ত যাহা লিখিত হইল, তাহাতে জানা যাইতেছে যে স্বপাপোক্তি যে পাপমুক্তির প্রধান উপায়, ইহা মহাত্মা মনুরও অভিমত।
যাঁহারা একমাত্র জ্ঞান-পথের পথিক, তাঁহাদিগের পক্ষে তত্ত্বজ্ঞানই তপস্যা। তৎপর যাঁহারা কেবল জ্ঞান লইয়াই সময় যাপন করেন না, প্রত্যুত জ্ঞান-মার্গাবলম্বীদিগের ও অন্যান্য বহুলোকের রক্ষাকার্য্যে নিযুক্ত থাকিয়া স্বদেশকে বিঘ্নবিপত্তি হইতে রক্ষা করেন, তাদৃশ্য সম্প্রদায়ী দিগের পক্ষে রক্ষণই তপঃ বলিয়া কথিত হয়। আর যাহারা পূর্বোক্ত সম্প্রদায়দ্বয়ের অন্তগত নহেন, কৃষি, ব্যাণিজ্য, পশুপালনাদি দ্বারা সমাজের একটি প্রধান অভাব দূর করেন, তাদৃশ শিক্ষিত শ্রেণীর পক্ষে বাত্তাই তপস্যা। আর যাহারানিতান্ত অজ্ঞান,
পূর্ব্বোক্ত ত্রিবিধ কার্য্যের মধ্যে কোনও কার্য্যেই সমর্থ নহে, তাহারা উক্ত শ্রেণীত্রয়ের সেবা দ্বারা সমাজের বহু অভাব দূর করিয়া থাকে। এই শ্রেণীর পক্ষে প্রথামোক্ত শ্রেণীত্রয়ের সেবাই তপস্যা যাহা হউক এ পর্য্যন্ত যাহা লিখিত হইল, তাহাতে জানা যাইতেছে যে স্বপাপোক্তি যে পাপমুক্তির প্রধান উপায়, ইহা মহাত্মা মনুরও অভিমত।
অপর, হিন্দুধর্ম্মের নানা বিভাগেই সাধকদিগকে এইরূপ দুঃখ প্রকাশ করিতে দেখা যায় যে,--
নারী-রত্নৈশ্চ রত্নৈশ্চসমাকৃষ্ট-মনাঃ সদা।
কালমযাপয়ম্ পূর্ব্বম্ কিঙ্করোমি জরাতুরঃ।।
অর্থাৎ আমি পূর্ব্বে অর্থাৎ যৌবনকালে সর্বদা নারীরত্ন ও রত্নকর্তৃক আকৃষ্ট-চিত্ত হইয়া কাল যাপন করিয়াছি এক্ষণে জরায় অতি কাতর হইয়াছি, এখন আর কি করিব ?
অতএব দেখা যাইতেছে যে, প্রথমেও যাঁহারা স্বীয় পাপোল্লেখ করেন নাই তাঁহারাও পরিণামে পাপোল্লেখ না করিয়া পারেন নাই। কিন্ত--
ভূতে পশ্যন্তি বর্ব্বরাঃ।
অর্থাৎ বর্ব্বরেরা কাল অতীত হইয়া গেলেই দোষগুণ দর্শন করে। এজন্য বলিতেছি যে, প্রথম জীবনেই পাপোল্লেখ করা সকলেরই উচিত। শুনিতে পাই খৃষ্টান ধর্ম্মের শাখা-বিশেষেও পাপোল্লেখের বন্দোবস্ত আছে এমন কি, দীক্ষা কালেই উহার উল্লেখ করা তাঁহাদিগের নিয়ম। অতএব পাপোল্লেখ বিশেষ করিয়া নির্দ্দেশ না করিলেও উহার কর্ত্তব্যতা যে,
সর্ব্ববাদি-সম্মত, তদ্বিষয়ে সন্দেহ নাই। ফলতঃ অনুতাপই যখন পাপমুক্তির প্রধান সাধক ( ক/ খ্যা পনেনানু তাপেন তপস্যা হধ্যয়নেনচ। পাপ কৃন্মুচ্যতে পাপাৎ, তথা দানেন চাপাদি । ইতি মনুঃ। অতএব অনুতাপ দ্বারা যে পাপমুক্তি হয়, ইহা মহাত্মা মনু বলিয়াছেন। খ/ কৃত্বা পাপানি সন্তাপ্য তস্মাৎ পাপাদ্ বিমুচ্যতে। অর্থাৎ পাপ করিয়া অনুতপ্ত হইলে ঐ পাপ হইতে মুক্ত হওয়া যায়। ইহা অন্যান্য মহাত্মাদিগের মত।), তখন যে কোনও উপায়ে অনুতাপ উপস্থিত হয়,
তাহাই অবলম্বনীয় জগদীশ্বরের অনন্ত গুণরাশির স্মরণ সহকারে স্বীয় পাপের উল্লেখ করিলে, যেরূপ আত্মগ্লানি বা অনুতাপ জন্মে, এরূপ আর কিছুতেই হয় না। এ কারণ স্বীয় পাপের উল্লেখ উপাসনার দ্বিতীয় অংশ বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। পূর্ব্বে যে উপাসনার দুইটি-- অংশের উল্লেখ করা হইয়াছে তদ্ভিন্ন প্রার্থনা নামে আরও একটি অংশ আছে।
অনেকে বলেন যে, "অনন্ত গুণ- নিধি, অনন্ত-পবিত্র ও অনন্ত-জ্যোতির্ম্ময় পরম পিতাকে আদর্শ করিলে এবং তদীয় গুণরাশি কীর্ত্তন-সহকারে তাঁহার সত্তা অনুভব ও তদীয় অরূপরূপ দর্শন করিলে, অবশ্যই ক্রমশঃ অনন্ত গুণ-নিধি, অনন্ত পবিত্র ও অনন্ত জ্যোতির্ম্ময় হইতে পারা যায়।
সর্ব্ববাদি-সম্মত, তদ্বিষয়ে সন্দেহ নাই। ফলতঃ অনুতাপই যখন পাপমুক্তির প্রধান সাধক ( ক/ খ্যা পনেনানু তাপেন তপস্যা হধ্যয়নেনচ। পাপ কৃন্মুচ্যতে পাপাৎ, তথা দানেন চাপাদি । ইতি মনুঃ। অতএব অনুতাপ দ্বারা যে পাপমুক্তি হয়, ইহা মহাত্মা মনু বলিয়াছেন। খ/ কৃত্বা পাপানি সন্তাপ্য তস্মাৎ পাপাদ্ বিমুচ্যতে। অর্থাৎ পাপ করিয়া অনুতপ্ত হইলে ঐ পাপ হইতে মুক্ত হওয়া যায়। ইহা অন্যান্য মহাত্মাদিগের মত।), তখন যে কোনও উপায়ে অনুতাপ উপস্থিত হয়,
তাহাই অবলম্বনীয় জগদীশ্বরের অনন্ত গুণরাশির স্মরণ সহকারে স্বীয় পাপের উল্লেখ করিলে, যেরূপ আত্মগ্লানি বা অনুতাপ জন্মে, এরূপ আর কিছুতেই হয় না। এ কারণ স্বীয় পাপের উল্লেখ উপাসনার দ্বিতীয় অংশ বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। পূর্ব্বে যে উপাসনার দুইটি-- অংশের উল্লেখ করা হইয়াছে তদ্ভিন্ন প্রার্থনা নামে আরও একটি অংশ আছে।
অনেকে বলেন যে, "অনন্ত গুণ- নিধি, অনন্ত-পবিত্র ও অনন্ত-জ্যোতির্ম্ময় পরম পিতাকে আদর্শ করিলে এবং তদীয় গুণরাশি কীর্ত্তন-সহকারে তাঁহার সত্তা অনুভব ও তদীয় অরূপরূপ দর্শন করিলে, অবশ্যই ক্রমশঃ অনন্ত গুণ-নিধি, অনন্ত পবিত্র ও অনন্ত জ্যোতির্ম্ময় হইতে পারা যায়।
একারণ গুণ-কীর্ত্তন অবশ্য কর্ত্তব্য এবং পাপমুক্তির নিমিত্ত স্বপাপোল্লেখও নিতান্ত বিধেয় বটে, কিন্ত প্রার্থনার কোনও প্রয়োজন নিরীক্ষিত হয় না।" ইহার উত্তরে বক্তব্য এই যে, অবশ্য এরূপ অবস্থা আছে যে, তৎকালে প্রার্থনায় কোনও প্রয়োজন থাকে না। কিন্ত যতকাল পর্য্যন্ত সেই মহোচ্চ অবস্থা লাভ করা না যায়, ততকাল পর্য্যন্ত প্রার্থনা যে অবশ্য-কর্ত্তব্য, তাহা নিঃসংশয়ে বলা যাইতে পারে।
আরও দেখ, প্রার্থনা যে কি মধুময়-সুধাময় পদার্থ তাহা বর্ণনা করিয়া অন্যের হৃদয়ঙ্গম করা অসাধ্য। যে সন্দেশ খাইয়াছে, বর্ণনা না শুনিলেও সে সন্দেশের মাধুর্য্য ও সুখকরত্ব জানিতে পারে। কিন্ত যে সন্দেশ খায় নাই, সহস্র বর্ণনা পাঠ করিয়াও সে সন্দেশের মাধুর্য্যের মর্ম্ম বুঝিতে পারে না। অতএব অনুরোধ করি, যিনি প্রার্থনার সুধাময়ত্ব জানিতে ইচ্ছু, তিনি একবার স্থিরচিত্তে প্রার্থনা করুন, তাহা হইলেই উহার মর্ম্ম বুঝিতে পারিবেন।
আরও দেখ, প্রার্থনা যে কি মধুময়-সুধাময় পদার্থ তাহা বর্ণনা করিয়া অন্যের হৃদয়ঙ্গম করা অসাধ্য। যে সন্দেশ খাইয়াছে, বর্ণনা না শুনিলেও সে সন্দেশের মাধুর্য্য ও সুখকরত্ব জানিতে পারে। কিন্ত যে সন্দেশ খায় নাই, সহস্র বর্ণনা পাঠ করিয়াও সে সন্দেশের মাধুর্য্যের মর্ম্ম বুঝিতে পারে না। অতএব অনুরোধ করি, যিনি প্রার্থনার সুধাময়ত্ব জানিতে ইচ্ছু, তিনি একবার স্থিরচিত্তে প্রার্থনা করুন, তাহা হইলেই উহার মর্ম্ম বুঝিতে পারিবেন।
দেবর্ষি নারদ স্বকৃত ভক্তিসূত্রে লিখিয়াছেন যে,--
"অনির্ব্বচনীয়ং প্রেমস্বরূপং মূকাস্বাদনবৎ।"
অর্থাৎ প্রেমের স্বরূপ অনির্ব্বচনীয়, উহা বাক্যদ্বারা প্রকাশ করা অসাধ্যা। দেখ, মূক (বোবা) যেমন কোনও মধুর রসের আস্বাদ লাভ করিয়া পরম সন্তষ্ট হয়, কিন্ত তাহা প্রকাশ করিতে পারে না., তদ্রূপ মনুষ্যও প্রেমলাভ করিয়া পরম আনন্দিত হয়, কিন্ত উহার সুখকরত্ব প্রকাশ করিতে পারে না।
প্রার্থনা সম্বন্ধেও আপত্তিকারিগন তদ্রূপ জানিবেন। অর্থাৎ প্রার্থনাকারী ব্যতীত প্রার্থনা-মাধুর্য্যের অনুভব করা অসাধ্যা, কেননা উহাও অনির্ব্বচনীয়। আর অনির্ব্বচনীয়ত্ব প্রযুক্তই বর্ণনা করিয়া উহা অন্যকে অনুভব করান যায় না। অনুবুভূষু, মানব একাগ্ৰ চিত্তে কতিপয়মাত্র দিবস প্রার্থনা করিলেই উহার গৌরব বোধে সমর্থ হইতে পারিবেন।
প্রার্থনা সম্বন্ধেও আপত্তিকারিগন তদ্রূপ জানিবেন। অর্থাৎ প্রার্থনাকারী ব্যতীত প্রার্থনা-মাধুর্য্যের অনুভব করা অসাধ্যা, কেননা উহাও অনির্ব্বচনীয়। আর অনির্ব্বচনীয়ত্ব প্রযুক্তই বর্ণনা করিয়া উহা অন্যকে অনুভব করান যায় না। অনুবুভূষু, মানব একাগ্ৰ চিত্তে কতিপয়মাত্র দিবস প্রার্থনা করিলেই উহার গৌরব বোধে সমর্থ হইতে পারিবেন।
এই প্রার্থনা তিন অংশে বিভক্ত --
১ম - পাপ হইতে মুক্তির জন্য প্রার্থনা।
২ম - গুণের নিমিত্ত প্রার্থনা।
এবং ৩য় - ভিক্ষা।
পাপ শব্দে জীব-হিংসা, ব্যভিচার প্রভৃতি দুষ্কৃতিমাত্র নহে। বত্ততঃ, ঐ সকল ব্যতিরেকে অষ্টপাশ জাতগুণের (কাম ক্রোধাদির) অলয় এবং কতিপয় মিশ্র গুণের অলয়ও পাপশব্দে বুঝিতে হইবে। তাহার কারণ এই গ্ৰন্থের প্রথমে নির্দিষ্ট হইয়াছে। তবে ইহা পরম সত্য যে, প্রথমে দুষ্কৃতি হইতে মুক্ত হইবার জন্য প্রার্থনা করাই কর্ত্তব্য। তৎপরে পাপমুক্তির জন্য, অনন্তর জাতগুণের লয়ের নিমিত্ত এবং সর্ব্বশেষে কতিপয় মিশ্রগুণের লয়ার্থে প্রার্থনা করা বিধেয়।
যেমন আত্মার মালিন্য পরিহারার্থে পূর্ব্বোক্তরূপ প্রার্থনা অবশ্য কর্ত্তব্য, তদ্রূপ আত্মার জ্যোতির্ম্ময়তা সম্পাদনের নিমিত্ত প্রার্থনা করা প্রয়োজনীয়। অবশ্য ইহা বক্তব্য যে, কি জাতগুণের লয়, কি লয়শীল মিশ্রগুণের লয়, কি গুণ লাভ করা, এই তিনটি বিষয়ের বিশেষ বিশেষ সাধনা আবশ্যক। কিন্তু সাধনা-কালেও প্রার্থনা করা একান্ত কর্ত্তব্য। এ জন্যই ১ম ও ২ম অবস্থায় প্রার্থনার আবশ্যকতা জানিবে।
আমার কিছুই নাই, তুমি যাহা কিছু দেও, তাহাই আত্মার প্রতিপালক। দৃঢ়তা সহকারে এইরূপ বাক্য উচ্চারণ করাকে ভিক্ষা কহে। ভিক্ষা বাস্তবিক নির্ভরতায় অঙ্কুর অবস্থা।
উপাসনাদি সম্বন্ধে এ পর্য্যন্ত যাহা কথিত হইয়াছে, তৎ সমুদায় পাঠ করিয়া পাঠকের মনে এই ভাবের উদয় হইতে পারে যে, যদিচ —
(১) উপাস্যকে আত্মায় আভরণ করাকে উপাসনা কহে।
এবং (২) গুণকীর্তন, স্বীয় পাপের উল্লেখ ও প্রার্থনা উপাসনার অঙ্গ বা বিভাগ হয়,
তথাপি গুণকীত্তনাদির বিষয় যেরূপ বুঝা গিয়াছে, প্রথমটি তদ্রূপ বিশদরূপে বুঝিতে পারা যায় নাই। অনন্ত গুণধাম পরমাত্মা তোমার উপাস্য, তুমি কিরূপে আত্মার অলঙ্কার করিবে ?
ইহার উত্তরে বক্তব্য এই যে, যেমন মৃগাক্ষীদিগের স্বভাব-সুন্দর বক্ষোদেশে মণিমুক্তাময় সুবর্ণ-হার ধৃত হইলে উহার অপূর্ব্ব সৌন্দর্য্য সম্পন্ন হয় বলিয়া ঐ রত্নহার অলঙ্কারাদি - শব্দে কথিত হইয়া থাকে, তদ্ধপ পরম পিতার গুণ - কীর্ত্তনাদি দ্বারা পাপমুক্ত ও বিবিধগুণযুক্ত হৃদয় নিসর্গতঃ পরম সুন্দর হইলেও অনন্ত সৌন্দর্য্য-নিধান পরমাত্মার অধিষ্ঠানে অসীম অতুল অনির্ব্বচনীয় শোভায় শোভমান হইলে উপাস্যকে আত্মার আভরণ করা হয়।
অতএব ঈশ্বর-দর্শন অথবা ঈশ্বরের সত্তা হৃদয়ে অনুভব না হইলে সম্পর্ণ উপাসনা হইতে পারে না। তবে ইহা সুনিশ্চিত যে উপাসনার পূর্ণতার জন্য সাধনারও প্রয়োজন আছে। সাধনা বিষয়ের সবিস্তার বিবরন দ্বিতীয় খণ্ডে বর্ণিত হইবে।
অতএব ঈশ্বর-দর্শন অথবা ঈশ্বরের সত্তা হৃদয়ে অনুভব না হইলে সম্পর্ণ উপাসনা হইতে পারে না। তবে ইহা সুনিশ্চিত যে উপাসনার পূর্ণতার জন্য সাধনারও প্রয়োজন আছে। সাধনা বিষয়ের সবিস্তার বিবরন দ্বিতীয় খণ্ডে বর্ণিত হইবে।
এক্ষণে জিজ্ঞাস্য হইতে পারে যে, কি কি কারণে ঈশ্বরের উপাসনা কত্তব্য ? এবং ঐ উপাসনা ও প্রার্থনার ফল কি ? ইহার উত্তরে বক্তব্য এই যে, এ পর্য্যন্ত যাহা বলা হইয়াছে, তাহাতেই উল্লিখিত বিষয়–সমূহের উত্তর প্রদত্ত হইয়াছে। তথাপি যদি কেহ তাহাতে সম্ভষ্ট না হন, তবে নিম্নলিখিত বিষয় মনোযোগ পূর্ব্বক পাঠ করুন।
প্রেমাস্পদ-গুণাখ্যানাৎ স্বাভাবিকা ন্নৃণাং সদা। অনন্তস্য মহিষ্ঠস্য সান্নিধ্যাচ্চিন্তনাচ্চবা। ক্ষুদ্রস্য মনসো লাভাৎ সৌন্দর্য্য পরমায়তেঃ। পথি চ মিলনাদ্দেবৈঃ সার্থক্যা জ্জন্মনন্তথা ।। প্রেম-ভক্ত্যাদি-সম্প্রাপ্তে রনন্ত- গুণ-চিন্তনৈঃ। দোষ রাশি প্রশমনা ন্নিদ্দোযস্য চ চিন্তনৈঃ।। বহ্বন্যকারণাচ্চৈব কত্তব্যোপাসনাবিভোঃ। চিন্ময়স্যা প্রমেয়স্য নির্গুণস্যা শরীরিণঃ।।
অর্থাৎ নিম্ন নির্দিষ্ট কারণ সমূহ — নিবন্ধন চিন্ময়, অপ্রমেয়, নির্গুণ, অশরীরী বিভুর উপাসনা করা কর্ত্তব্য।
(১) মনুষ্যেরা স্বভাবতঃই প্রেমাস্পদের গুণকীর্ত্তন করে আর জগদীশ্বর সর্বাপেক্ষা প্রেমাস্পদ, একারণ তদীয় গুণকীর্ত্তন বা উপাসনা করা বিধেয়।
(২) অনন্ত মহিষ্ঠ পরমেশ্বরের সান্নিধ্যবশতঃ বা চিন্তনপ্রযুক্ত ক্ষুদ্রমনের উদারতা-সহকৃত বিশালতার প্রাপ্তির জন্য,
(৩) পথে দেবগণের সহিত মিলনের জন্য, অর্থাৎ উপাসনা দ্বারা ঈশ্বর-দর্শন-লাভে প্রবৃত্ত হইলে, ঐ দর্শনের পূর্ব্বে দেবদর্শন ও দেবগণের সহিত মিলন অর্থাৎ কথোপকথনাদি সম্পন্ন হয়, তাহাতে যেমন পরমানন্দলাভ হয়, তেমনই ঈশ্বর-লাভের সদুপায়ও হইয়া থাকে। এই তৃতীয় কারণবশতঃ বিভুর উপাসনা কর্ত্তব্য। যদি বল,
দেবগণের পূজাদিদ্বারা অগ্ৰে তাঁহাদিগের দর্শন লাভ করিয়া, পশ্চাৎ পরমেশ্বরের উপাসনা করাই ত সঙ্গত। তাহার উত্তর এই যে, প্রকৃতভাবে সদ্ গুরু-কর্ত্তৃক দীক্ষিত হইয়া ভক্তি ও একাগ্ৰতা সহকারে পরমাত্মার উপাসনায় প্রবৃত্ত ব্যাক্তি একমাসের মধ্যেই দেবদর্শন লাভ করিতে পারেন, কিন্ত পরমাত্মার উপাসনা না করিয়া অন্য উপায়ে দেব-দর্শন করিতে গেলে কত
জন্ম যে অতিবাহিত হয়, তাহা আর কি নির্দেশ করিব ? দেখ সর্বানন্দ পূর্ব্ব পূর্ব্ব জন্মে উৎকৃষ্ট শাস্ত্রজ্ঞান-সম্পন্ন ও সমাচার বিশিষ্ট হইয়াও বহু জন্মের পরে ভগবতীর দর্শন লাভ করিয়াছিলেন। এই তৃতীয় কারণবশতঃ বিভুর উপাসনা কর্ত্তব্য।
দেবগণের পূজাদিদ্বারা অগ্ৰে তাঁহাদিগের দর্শন লাভ করিয়া, পশ্চাৎ পরমেশ্বরের উপাসনা করাই ত সঙ্গত। তাহার উত্তর এই যে, প্রকৃতভাবে সদ্ গুরু-কর্ত্তৃক দীক্ষিত হইয়া ভক্তি ও একাগ্ৰতা সহকারে পরমাত্মার উপাসনায় প্রবৃত্ত ব্যাক্তি একমাসের মধ্যেই দেবদর্শন লাভ করিতে পারেন, কিন্ত পরমাত্মার উপাসনা না করিয়া অন্য উপায়ে দেব-দর্শন করিতে গেলে কত
জন্ম যে অতিবাহিত হয়, তাহা আর কি নির্দেশ করিব ? দেখ সর্বানন্দ পূর্ব্ব পূর্ব্ব জন্মে উৎকৃষ্ট শাস্ত্রজ্ঞান-সম্পন্ন ও সমাচার বিশিষ্ট হইয়াও বহু জন্মের পরে ভগবতীর দর্শন লাভ করিয়াছিলেন। এই তৃতীয় কারণবশতঃ বিভুর উপাসনা কর্ত্তব্য।
(৪) চর্তথ কারণ জন্মগ্ৰহনের সার্থকতা। আমি যাঁহার করুণায়, মোহাবস্থায় সুখময়ী ও জ্ঞানাবস্থায় সুধাময়ী পৃথিবীতে আগমন করিয়াছি, তিনি আমার স্রষ্টা ও পাতা এবং যিনি প্রতিমুহূর্ত্তে বিপত্তি-বিনাশদ্বারা আমার মঙ্গলবিধাতা, আমি যদি তাহার উপাসনা না করি, তদীয় গুণরাশির কীর্ত্তন না করি, তাঁহার নিকটে কৃতজ্ঞতা-প্রকাশ না করি, তবে কি আমার জন্মগ্ৰহন সার্থক হয় ? কখনই নহে। অতএব জন্মগ্ৰহনের সার্থকতা জন্যও জগদীশ্বরের উপাসনা কর্ত্তব্য।
(৫) পরমেশ্বরের অনন্তগুণরাশির পুনঃ পুনঃ চিন্তনদ্বারা প্রেম ভক্তি প্রভৃতি গুণলাভ করা পঞ্চম কারণ। দেখ, সাধু-সঙ্গে যে গুণলাভ হয়, তাহার কারণও সাধুর গুণানুশীলন ও গুণদর্শন। সুতরাং অনন্তরূপে অনন্ত সাধুত্বের আধার গুণধাম জগদীশ্বরের পুনঃ পুনঃ গুণরাশির চিন্তনদ্বারা যে সদ্ গুণ-সমূহের লাভ হইবে, ইহাতে আর সন্দেহ কি ?
(৬) দোষলেশ - শূন্য জগদীশ্বরের পুনঃ পুনঃ চিন্তাদ্বারা স্বকীয় দোষরাশির প্রশমন ষষ্ঠ কারণ। ইহার ব্যাখ্যা পূর্ব্ববৎ।
(৭) এতদ্ভিন্ন অন্য বহুকারণেও চিন্ময়, অপ্রমেয়, নির্গুণ, অশরীরী বিভু পরমেশ্বরের উপাসনা কর্ত্তব্য।
0 মন্তব্যসমূহ