জীবের ভেদ হেতু।


  জীবের ভেদ হেতু।

          এক্ষণে বিবেচনা করিয়া দেখিলে সহজেই বোধ হইবে যে,মানব দেহের যেমন উন্নত ভাবের বিলোপ হইয়াছে,ইতর জীবেও ঠিক তদ্রূপ হইয়াছে।অধিকন্তু কতিপয় জাতীয় ইতর জীবের বংশ একেবারে বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে। এক্ষণে জিজ্ঞাস্য হইতে পারে যে কতকগুলি জীবের বংশ - বিলোপ কেন হইয়াছে? ইহার উত্তর এই যে মঙ্গলময় জগদীশ্বরের বিবংহয়িষা যেমন নিত্যা, তেমনই উহা যে তিন ভাগে বিভক্ত, সেই ভাগত্রয়ও নিত্য অর্থাৎ অবিনাশী।


 ঐ ভাগত্রয়ও নাম যথাক্রমে সিসৃক্ষা, রিরক্ষিষা ও জিহীর্ষা। এই জিহীর্ষাও সিসৃক্ষা রিরক্ষিষা নামক ইচ্ছাদ্বয়ের ন্যায় অবিনাশিনী। অতএব জগতের যখন যাহার প্রয়োজন, তদতিরিক্তদিগের বিলোপ ঐ জিহীর্ষা দ্বারাই হইয়া থাকে।


        এক্ষণে মানবে ও ইতর জীবে কি প্রভেদ তাহা বিবেচনা করিলে প্রতীয়মান হইবে যে, ইতর জীবগণ তমঃপ্রধান বা রজস্তমঃপ্রধান, কিন্তু মানব সত্ত্ব প্রধান বা রজঃসত্ত্ব-প্রধান, ইহাই প্রভেদ। কিন্তু এতাদৃশ দুর্ভাগ্য মানবেরও অভাব নাই যে তাহারা রজঃস্তম প্রধান বা তমঃপ্রধান।


সুতরাং ঐ সকল তমঃপ্রধান বা রজস্তমঃ-প্রধান ইতরজীবের ন্যায় তাহাদের বংশও যখন জগতের অনুপযুক্ত হইবে তখনই তৎসমুদায়ও যে বিলুপ্ত হইয়া যাইবে, তদ্বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। অতএব, হে মানবগণ! হে বংশরিরক্ষিষু মনুষ্যবৃন্দ! তোমরা যদি স্বীয় বংশপ্রবাহ চিরস্থায়ী করিতে ইচ্ছা কর, 


 তবে আপনার ধর্ম্মানুষ্ঠান-পূর্ব্বক মোক্ষমার্গের পথিক হও এবং স্ব স্ব বংশীয়েরা যাহাতে ধার্ম্মিক ও সদ্ গুণসম্পন্ন হয়, তাহার জন্য সবিশেষ চেষ্টা কর। নতুবা পাশব বলের প্রধান্য জন্য মোহাচ্ছন্ন হইয়া অবক্তব্য বাক্য বলিও না, অকর্তব্য কার্য্য করিও না এবং অচিন্তয়িতব্য কুৎসিত বিষয়ের চিন্তা করিও না।


 হে ভাতৃগণ ! হে পরম স্নেহাম্পাদগণ ! হে প্রাণ-প্রতিমা জগন্নিবাসিগণ! তোমরা শিষ্ট হও,শান্ত হও, ভক্ত হও, প্রেমিক হও, জ্ঞানী হও এবং সৎকর্ম্মান্বিত ও সদিচ্ছা-পরিচালিত হও। তোমরা একে অন্যকে প্রহার করিও না,  অবজ্ঞা করিও না। অধম ভাবিও না। তোমরা সকলেই একি মহান্ পরমেশ্বরের পরম অংশ। তোমরা সকলেই পার্থিব বিষয় আসক্ত হইও না, রুপ-মোহে মুগ্ধ হইও না, এবং ভ্রান্তিমার্গে পরিচালিত হইও না।


 সকলেই সংসারের উন্নতি কর, পার্থিব জগতের শ্রীবৃদ্ধি এবং বাসস্থান, খাদ্য পরিধয়াদি সম্বন্ধে উৎকৃষ্ট পদ্ধতি অবলম্বন কর। তবে পার্থিব যে কার্য্যই করো না কেন, তাহাতে একান্ত ব্যাক্তিগত হইও না। রজ্জুর উপরি ভাগে অবস্থান করিতে করিতে নৃত্যগীত-লয়তানকারী নট যেমন মৌলি-নিষ্ঠ কলসী বিস্মৃত হয় না, সেইরূপ তোমরাও সমস্ত প্রয়োজনীয় কার্য্য কর, 


কিন্তু কোনও কার্য্যেই সেই সর্ব্বভূত-সুহৃদ পরমপুরুষকে বিস্মৃত হইও না। সর্ব্বদাই তঁহাকে স্ব স্ব হৃদয়াসনে আসীন রাখ এবং তদিয় ভজনায় রত থাক। যদি তাহাতে তোমাদের অনুমাত্র ভক্তি থাকে, যদি সকলের পরম পিতাকে পিতা বলিয়া এবং তদীয় সন্তান মানববৃন্দকে ভ্রাতৃ ভগিনী জ্ঞান করিয়া থাক,  এবং যদি পরকালের তুলনায় ক্ষুদ্রতম বলিয়া প্রতীয়মান এই পৃথিবীবাসের অনিত্যতা স্বীকার করিতে সম্মত হও, তবে অবহিত চিত্তে   অপ্রমত্ত মনে কার্য্য করিতে থাকো। 


এবং পরহিংসা, পরদ্বেষ ও পরনিন্দা, একেবারে দূরে নিক্ষিপ্ত কর। নানাশাস্ত্র অধ্যয়ন দারা বুদ্ধির সংশোধন-পূর্ব্বক অনিত্যতা বিষয়ে প্রগাঢ় চিন্তা করিয়া অহঙ্কারকে একেবারে বিদূরিত করো। সৎসঙ্গ, সদালাপ ও সাধু-সেবা দ্বারা মনের সংশয়ভাব-নিরাকরণ-পূর্ব্বক দৃঢ়তর বিশ্বাস-সহকারে অন্তত গুণবিধান অসীম শক্তিপূর্ণ পরাৎপর মঙ্গলময় জগদীশ্বরের প্রিয়কার্য্য সম্পাদন-পুরঃসর স্ব স্ব জীবন চরিতার্থ জন্মগ্রহণ সার্থক কর। 


 আর ঐরূপ কার্যদ্বারা তোমরা সকলে ধন্য হও এবং তোমাদিগের স্বর্গাদপি গরীয়সী এই জন্মভূমি পৃথিবী ধন্য ধন্য হউক। হে করুণাময়! এই পৃথিবীবাসী জনগণের প্রতি কৃপা বিতরণ কর এবং নিজগুণে ইহাদিগের প্রতি অনুগ্রহ-কিরণ বিকীর্ণ করিয়া, ইহা দিগকে প্রগাঢ় অন্তস্তমোজাল হইতে বিমুক্ত কর। দয়াময়! দয়াকর।
         
                -  ঈশ্বর গুরুনাথ সেনগুপ্ত।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ