অদৃষ্টবাদ ও কর্ম্ম-ফল।
অদৃষ্ট কেহ কেহ স্বীকার করেন। আবার আজকাল অনেকে স্বীকার করেন না। স্নান করিলে শরীর শীতল হয়, আহার করিলে শরীর সবল হয় এবং অনলের নিকট অবস্থান করিলে অত্যাল্প কালের মধ্যেই শীতল শরীর উত্তপ্ত হয়। ইহা সকলেই জ্ঞাত আছেন। সুতরাং কর্ম্মফল অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবে । ঐ কর্ম্ম যে ফলভোগের পূর্ব্বেই সম্পাদিত হইয়াছে ইহা বলাই বাহুল্য। এ কারণ পূর্ব্ব কর্ম্ম যে পরবর্ত্তিনী অবস্থার একটী প্রধান কারণ, তদ্বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই ।
পূর্ব্বার্জ্জিত কর্ম্মকেই অদৃষ্ট কহে । এস্থলে বক্তব্য এই যে, ' পূর্ব্বার্জ্জিত' পদে যখন 'বর্ত্তমান সময়ের পূর্ব্বে সম্পাদিত' বুঝাইতেছে, তখন উহা বর্ত্তমান জন্মকৃত বা জন্মান্তরোদ্ভূত কিংবা "পূর্ব্ব ও বর্ত্তমান উভয় জন্মে সম্পাদিত" এই তিন প্রকারই হইতে পারে। এই ত্রিবিধ কর্ম্মই পরবর্ত্তিনী অবস্থায় সম্পাদন বিষয়ে যে একতম কারণ, তদ্বিষয়ে সন্দেহ নাই।
আবার তুমি স্নান করিয়া আসিয়াই অগ্নির নিকটে বা ঘোরতর রৌদ্রের মধ্যে বসিয়া রহিলে এবং আহার করিয়াই বমনদ্বারা ভক্ত অন্ন সমুদায় উদ্গীর্ণ করিয়া দিলে, এরূপ অবস্থায় যথাক্রমে তোমার শরীর শীতল বা সবল হইতে পারিল না। সুতরাং পূর্ব্বকর্ম্ম বা অদৃষ্ট ও যেমন ফলোৎপত্তির প্রতি কারণ, বর্ত্তমান কর্ম্ম বা পুরুষকারও তদ্রুপ বা অনেক স্থলে তদপেক্ষায় ও প্রধান কারণ, তদ্বিষয়ে কোন সংশয় নাই ।
এই পূর্ব্বকর্ম্মকে অদৃষ্ট এবং বর্ত্তমান কর্ম্মকে পুরুষকার কহে। অদৃষ্টের পর্য্যায় শব্দ যথা- দৈব, দিষ্ট, ভাগধেয়, ভাগ্য, নিয়ত ও বিধি। এবং পুরুষকারের পর্য্যায় শব্দ যথা- পুরুষকার, পৌরুষ, কর্ম্ম ইত্যাদি।
যেমন ক্ষেত্র উৎকৃষ্ট এবং বীজ উৎকৃষ্ট হইলেও অকালে শস্যোৎপত্তি হয় না, তদ্রূপ অদৃষ্ট ও পুরুষকার উভয় সত্ত্বেও অকালে কখন ও কার্য্যোৎপত্তি হয় না । একারণ কার্য্য- সম্পাদন বিষয়ে অদৃষ্ট ও পুরুষকার যেমন, কাল ও তদ্রূপ কারণ জানিবে। ফলতঃ, অদৃষ্ট, পুরুষাকার ও কাল এই তিনের সংযোগ ব্যতীত কোন ও ফলই উৎপন্ন হইতে পারে না ।
কেহ কেহ অদৃষ্ট ও পুরুষাকরকেই ফলোৎপত্তির কারণ বলিয়া নির্দ্দেশ করেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাহা নহে। উল্লিখিত তিনটিই ফলোৎপত্তি সম্বন্ধে কারণ। যেরূপ যত্ন অন্যান্য সকলে করে, তুমি তদ্রূপ যত্ন করিতেছ, তোমার বীজ ও উৎকৃষ্ট কিন্তু যে ধান্য পৌষমাসে জন্মে, তাহা বৈশাখ মাসে অথবা যে আম্র বৈশাখাদি মাসে পাকে, তাহা শীতকালে পৌষমাসে পাকাইতে পারিবে না। সুতরাং কালকেও একটী প্রধান কারণ অবশ্য মানিতে হইবে ।
তবে ইহা অবশ্য বলিতে হইবে যে, প্রবল পুরুষাকার-প্রভাবে অনতিক্রম্য অদৃষ্ট ব্যতীত যেমন অন্য দ্বিবিধ অদৃষ্টই বিধ্বস্ত হইতে পারে, তদ্রূপ বলবৎ পৌরুষযোগে ত্রিবিধ কালের মধ্যে অনতিক্রম্য কাল ব্যাতিরেকে অন্য দ্বিবিধ কালকেই প্রতিকূলতায় অসমর্থ করা যাইতে পারে।
পৌষমাসে বঙ্গদেশে প্রবল শীত বলিয়া আম্র পরিপক্ক হওয়া দূরে যাউক,জাতাঙ্কুরও হয় না, কিন্তু ঐ সময় মান্দ্রাজ প্রভৃতি স্থানে আম্র পক্ব হইয়া থাকে । যদি পুরুষকার প্রভাবে কালশক্তি বিধ্বস্ত করিবার উপায় অবলম্বন করা যায়, তবে এতদ্দেশেও ঐ সময়ে আম্রাঙ্কুর উৎপন্ন বা বর্দ্ধিত অথবা আম্র পরিপক্ক হইতে পারে ।
একারণ পুরুষাকারই সর্ব্বপ্রধান। পুরুষাকার অতিপ্রবল প্রবল ও দুর্ব্বল ভেদে তিন প্রকার। আর কাল ও অদৃষ্টের ন্যায় অতিক্রম্য, দূরতিক্রম্য ও অনতিক্রম্য ভেদে ত্রিবিধ। যে অদৃষ্ট অতি প্রবলের কথা দূরে থাকুক, প্রবল পুরুষাকারদ্বারা ও অতিক্রম করা যায়, তাহাকে অতিক্রম্য অদৃষ্ট কহে।
যে অদৃষ্ট একমাত্র অতিপ্রবল পুরুষাকার দ্বারা অতিক্রান্ত হইতে পারে, তাহাকে দুরতিক্রম্য অদৃষ্ট কহে। আর যে অদৃষ্ট কোনও প্রকার পুরুষকারেরই অতিক্রান্ত হয় না, কিন্তু প্রবল পুরুষকারে অল্পতর তেজঃসম্পন্ন হয়, তাহাকে অনতিক্রম্য অদৃষ্ট কহে। পূর্বোক্তরূপে কালও ত্রিবিধ।
পূর্বোল্লিখিত বিবরণ পাঠে অবশ্যই প্রতীয়মান হইবে যে, যখন পূর্ব্বকর্ম্মই পরবর্ত্তী সময়ের অদৃষ্ট বলিয়া কথিত হয়, তখন তাহা কর্ম্ম ব্যতীত আর কিছুই নহে। তবে এক্ষণে তাহা জানা যাইতেছে না বলিয়াই "অদৃষ্ট" বলিয়া উক্ত হইতেছে। ( ন দৃষ্ট অদৃষ্ট; দৃশ+ ক্ত; এখানে দৃশ ধাতু জ্ঞানার্থক।)
অদৃষ্ট ও পুরুষকার সম্বন্ধে নীতিশাস্ত্রকারেরা বলেন যে-
উদ্যোগিনং পুরুষসিংহ মুপৈতি লক্ষ্মী-
র্দৈবেন দেয়মিতি কাপুরুষা বদন্তি ।
দৈবং নিহত্য কুরু পৌরুষমাত্মাশক্ত্যা
যত্নে কৃতে যদি ন সিধ্যতি কোঽত্র দোষঃ ।।
অর্থাৎ লক্ষ্মী উদ্যোগী পুরুষসিংহকে আশ্রয় করেন । অদৃষ্ট অনুসারে সৌভাগ্য হয়, ইহা কাপুরুষেরা বলে। তুমি আত্মশক্তি দ্বারা দৈবকে বিধ্বস্ত করিয়া পৌরুষ প্রকাশ কর । যদি যত্নকৃত হইলেও কার্য্য সিদ্ধি না হয়, তবে এ বিষয়ে আর কি দোষ আছে ?
এই কবিতা পাঠে স্পষ্ট প্রতীতি হয় যে, গ্রন্থকার পৌরুষের পক্ষপাতী। কিন্তু কখনও কখনও যে অতি প্রবল পুরুষকার ও দৈবের নিকটে পরাস্ত হয়, তাহাও শেষভাগে প্রকারান্তরে প্রকাশ করিয়াছেন ।
প্রকৃতপক্ষে ও কার্য্য ক্ষুদ্র বা মহৎ হউক, সেদিকে দৃষ্টিপাত না করিয়া প্রবল পুরুষকার প্রকাশ পূর্ব্বক কার্য্যসাধন করাই কর্ত্তব্য। একারণ নীতিবেত্তা চাণক্য, সিংহের নিকট হইতে যে একটা গুণ শিক্ষা করিতে হইবে, তৎসম্বন্ধে বলিয়াছেন যে,-
প্রভূতং কার্য্যমল্পং বা যন্নরঃ কর্ত্তুমিচ্ছতি।
সর্ব্বারম্ভেণ তৎকার্য্যং সিংহাদেকং প্রকীর্ত্তিতম্।
অর্থাৎ প্রভূতই হউক, অথবা অল্পই হউক মনুষ্য যে কার্য্যই করুক না কেন,তাহা সর্ব্বারম্ভে করিবে । ইহা সিংহ হইতে শিক্ষণীয় কার্য্য বলিয়া কীর্ত্তিত হইতেছে।
অদৃষ্ট ও পৌরুষ সম্বন্ধে মহাভারতে অনুশাসন পর্ব্বে ষষ্ঠ অধ্যায়ে এইরূপ উক্ত আছে, যথা-
যুধিষ্ঠির উবাচ
পিতামহ মহাপ্রাজ্ঞ সর্ব্বশাস্ত্রবিশারদ !
দৈবে পুরুষকারে চ কিং স্বিচ্ছ্রেষ্ঠতরং ভবেৎ।।
ভীষ্ম উবাচ
অত্রাপ্যুদাহরন্তীম মিতিহাসং পুরাতনম্।
বশিষ্ঠস্য চ সংবাদং ব্রহ্মণশ্চ যুধিষ্ঠির।।
দৈবমানুষয়োঃ কিং স্বিৎ কর্ন্মণোঃ শ্রেষ্ঠমিত্যুত।
পুরা বশিষ্ঠো ভগবান্ পিতামহ মপৃচ্ছত ।।
ততঃ পদ্মোদ্ভবো রাজন্ দেবদেবঃ পিতামহঃ।
উবাচ মধুরং বাক্য মর্থবদ্ধেতু- ভূষিতম্ ।।
ব্রহ্মোবাচ
না বীজং জায়তে কিঞ্চিন্ন বীজেন বিনা ফলম্ ।
বীজাদ্ বীজং প্রভবতি বীজাদেব ফলং স্মৃতম্ ।।
যাদৃশং বপতে বীজং ক্ষেত্রমাসাদ্য কর্যকঃ।
সুকৃতে দুস্কৃতে বাপি তাদৃশং লভতে ফলম্।।
যথা বীজং বিনা ক্ষেত্র মুপ্তং ভবতি নিস্ফলম্।
তথা পুরুষকাররেণ বিনা দৈবং ন সিধ্যতি।।
ক্ষেত্রং পুরুষকারস্ত দৈবং বীজ মুদাহৃতম্।
ক্ষেত্রবীজ-সমযোগাত্ততঃ শস্যং সমৃধ্যতে।।
কর্ম্মণঃ ফল-নির্বৃত্তিং স্বয়মশ্নাতি কারকঃ।
প্রত্যক্ষং দৃশ্যতে লোকে কৃতস্যাপকৃতস্য চ ।।
শুভেন কর্ম্মণা সৌখ্যং দুঃখং পাপেন কর্ম্মণা।
কৃতং ফলতি সর্ব্বত্র নাকৃতং ভুজ্যতে ক্বচিৎ।।
কৃতী সর্ব্বত্র লভতে প্রতিষ্ঠাং ভাগ্যসংযুতাম্ ।
অকৃতী লভতে ভ্রষ্টঃ ক্ষতে ক্ষারাবসেচনম্।।
তাপস্যারূপসৌভাগ্যং রত্নানি বিবিধানি চ ।
প্রাপ্যতে কর্ম্মণা সর্ব্বং ন দৈবাদকৃতাত্মনা।।
তথা স্বর্গশ্চ ভোগশ্চ নিষ্ঠা যা চ মনীষিতা।
সর্ব্বং পুরুষকারেণ কৃতেনেহোপলভ্যতে।।
অর্থো বা মিত্রবর্গো বা ঐশ্বর্য্যং বা কুলান্বিতম্।
শ্রীশ্চাপি দুর্লভা ভোক্তুং তথৈবাকৃতকর্ম্মাভিঃ।।
শৌচেন লভতে বিপ্রঃ ক্ষত্রিয়ো বিক্রমেণ তু ।
বৈশ্যঃ পুরুষকারেণ শূদ্র শুশ্রূষয়া শ্রিয়ম্ ।।
নাদাতরং ভজন্ত্যর্থা ন ক্লীবং নাপি নিস্ক্রিয়ম্।
না কর্ম্মশীলং না শূরং তথা নৈবাতপস্বিনম্।।
* * * * * *
অকৃত্বা মানুষ্যং কর্ম্ম যো দৈবমনুবর্ত্ততে।
বৃথা শ্রাম্যতি সম্প্রাপ্য পতিং ক্লীবমিবাঙ্গনা।।
কৃতঃ পুরুষকারস্তু দৈবমেবানুবর্ত্ততে।
ন দৈব মকৃতে কিঞ্চিৎ কস্যচিদ্ দাতুমর্হতি।।
দৈবস্য কর্ম্মাধীনত্ব মাহ দ্বাভ্যাম্ --
যথাঽগ্নিপবনোদ্ভূতঃ সুসৃক্ষ্যোঽপি মহান্ ভবেৎ ।
তথা কর্ম্ম-সমাযুক্তং দৈবং সাধু বিবর্দ্ধতে।।
যথা তৈলক্ষয়াদ্দীপঃ প্রহ্রাস মুপগচ্ছতি।
তথা কর্ম্মক্ষয়াদ্ দৈবং প্রহ্রাস মুপগচ্ছতি।
ন চ ফলতি বিকর্ম্মা জীবলোকে ন দৈবং
ব্যপনয়তি বিমার্গাং নাস্তি দৈবে প্রভুত্বম্।
গুরুমিব কৃতমগ্র্যং কর্ম্ম সংযাতি দৈবং
নয়তি পুরুষকারঃ সঞ্চতি স্তত্র তত্র।।
অর্থাৎ যুধিষ্ঠির বললেন, হে সর্ব্বশাস্ত্রবিশারদ মহাপ্রাজ্ঞ পিতামহ। দৈব ও পুরুষকার এই উভয়ের মধ্যে কোনটী শ্রেষ্ঠতর ? ভীষ্ম বলিলেন, হে যুধিষ্ঠির আমি এই বিষয়ে ব্রহ্মা ও বশিষ্ঠের কথোপকথনরূপ একটি পুরাতন ইতিহাসের উদাহরণ দিতেছি।--
পূর্ব্বে ভগবান বশিষ্ঠ " দৈব ও মানষ-কর্ম্মের মধ্যে কোনটী শ্রেষ্ঠ" ইহা ব্রহ্মার নিকটে জিজ্ঞাসা করিলেন। অনন্তর হে রাজন্ । পদ্মোদ্ভব দেবদেব পিতামহ অর্থযুক্ত ও হেতভূষিত মধুর বাক্য বলিলেন।--
ব্রহ্মা বলিলেন, অবীজ কোন দ্রব উৎপন্ন হয় না। বীজ বিনা ফল হইতে পারে না, বীজ হইতে বীজ উদ্ভূত হয় এবং বীজ হইতেই ফল হয়। কর্ষক অর্থাৎ কৃষিকারী যাদৃশ ক্ষেত্র প্রাপ্ত হইয়া বীজ বপন করে, তাদৃশ ফললাভ করিতে পারে, অর্থাৎ ক্ষেত্র ভাল হইলে ভাল ফল হয় এবং মন্দ হইলে মন্দ ফল প্রাপ্তি হয়।
যে ক্ষেত্র বিনা ( অর্থাৎ বালুকাময় ভূমিতে) উপ্ত বীজ নিস্ফল হয়, তদ্রূপ পুরুষকার বিনা দৈব সিদ্ধি হয় না। এখানে পুরুষকারকে ক্ষেত্র এবং দৈব বীজ বলিয়া উদাহরণ দেওয়া হইয়েছে। ক্ষেত্র-বীজ-সমাযোগ হইলে তবে শস্য সমৃদ্ধ হয়। কারক উৎকৃষ্ট বা অপকৃষ্ট কর্ম্মের ফলভোগ স্বয়ংই করে, ইহা জগতে প্রত্যক্ষ দেখা যায়। শুভ কর্ম্মদ্বারা সুখ এবং পাপকর্ম্ম দ্বারা দুঃখ হয়; কৃত কর্ম্মই সর্ব্বত্র ফলে, কোথায়ও অকৃত উপযুক্ত হয় না। কৃতী সর্ব্বত্র ভাগ্যসংযুতা প্রতিষ্ঠা লাভ করে, অকৃতী ভ্রষ্ট হইয়া ক্ষতে ক্ষারাবসেচন লাভ করে।
এখন কর্ম্ম ও দৈবের প্রাবল্য ও দৌর্বল্য উক্ত হইতেছে।
তপস্যা, রূপ, সৌভাগ্য এবং বিবিধ রত্নসমূহ সমস্তই কর্ম্ম- দ্বারা পাওয়া যায়, কর্ম্ম না করিলে কেবল দৈব হইতে পাওয়া যায় না। কি স্বর্গ, কি ভোগ, কি মনীষিতা নিষ্ঠা সকলই স্বকৃত পুরুষকার দ্বারা এই জগতে উপলব্ধ হইতে পারে। অকৃতকর্ম্মা পুরুষদিগের পক্ষে কি অর্থ, কি মিত্রবর্গ, কি কুলান্বিত ঐশ্বর্য্য এবং কি শ্রী সকলই ভোগার্থ দুর্লভ। বিপ্র শৌচদ্বারা, ক্ষত্রিয় বিক্রমদ্বারা, বৈশ্য পুরুষকারদ্বারা এবং শূদ্র শুশ্রূষা দ্বারা শ্রী লাভ করে। অর্থসকল অদাতাকে, ক্লীবকে, নিস্ক্রিয় ব্যক্তিকে, অকর্ম্মশীলকে, শৌর্যরহিত ব্যক্তিকে এবং তপস্যরহিত মানবকে ভজনা করে না।
এক্ষণে দৈব যে কর্ম্মের অধীন, তাহা কথিত হইতেছে। যেমন সুসূক্ষ্ম অগ্নিও পবনোদ্ভূত হইয়া হয়, সেইরূপ দৈব পুরুষকারের সহিত সংযুক্ত হইয়া উত্তমরূপে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়। যেমন তৈল-ক্ষয়ে দীপ হ্রাসভাব প্রাপ্ত হয়, তদ্রূপ কর্ম্মক্ষয়ে দৈবও প্রহ্রাস প্রাপ্ত হয়।
পুরুষকারহীন ব্যক্তি ফল অর্থাৎ তৃপ্ত্যাদি প্রাপ্ত হয় না এবং কেবল দৈব বিমার্গাগামী নরকে সন্মার্গে নীত করিতে পারে না। ( অতএব দৈবে প্রভুত্ব নাই) । শিষ্য যেমন গুরুর অনুগমন করে, তদ্রূপ দৈবও পুরুষকারের অনুসরণ করিয়া থাকে। অতএব পুরুষকার যে যে বিষয়ে সঞ্চিত অর্থাৎ সম্যক্ অনুষ্ঠিত হয়, সেই সেই বিষয়ে সে দৈবকে আবির্ভূত করায় অর্থাৎ পুরুষকার দ্বারা কোনও বিষয় সিদ্ধ হইলে, " ইহা দৈবানুকূল্যে" সিদ্ধ হইয়াছে বলিয়া লোকে বলে।
দৈব যেরুপই হউক, একবার পুণ্য সঞ্চয় করিতে পারিলে, দৈবানুসারে আর কোনও অনিষ্ট হইতে পারেনা। এ বিষয়ও মহাভারতে উক্ত হইয়াছে। যথা--
দেবানং শরণং পুণ্যং সর্ব্বং পুণ্যৈরবাপ্যতে ।
পুণ্যশীলং নরং প্রাপ্য কিং দৈবং প্রকারষ্যতি।।
পুরা যযাতি র্বিভ্রষ্টশ্চ্যাবিতঃ পতিতঃ ক্ষিতৌ।
পুনরারোপিতঃ স্বর্গং দৌহিত্রৈঃ পুণ্যকর্ম্মভিঃ।।
ইত্যাদি।
অর্থাৎ পুণ্য দেবগণের শরণ, সকলই পুণ্যদ্বারা প্রাপ্ত হওয়া যায় । দৈব পুণ্যশীল নরের কি করিতে পারে ? পূর্ব্বে যযাতি রাজ্য ভ্রষ্ট ও চ্যাবিত হইয়া ক্ষিতিতলে পড়িতেছিলেন, কিন্তু তদীয় পুণ্যকর্ম্মা দৌহিত্রগণ তাঁহাকে পুণরায় স্বর্গে আরোহণ করাইয়াছিলেন। ইত্যাদি।
অদৃষ্ট ও পুরুষকারের বিষয় এপর্য্যন্ত যাহা বলা হইল, বোধ করি তদপেক্ষা আর বিস্তারিত বর্ণনার প্রয়োজন নাই। এক্ষণে কালের বিষয় কিঞ্চিৎ বর্ণনা করিয়া প্রস্তাবের উপসংহার এক্ষণে কালের বিষয় কিঞ্চিৎ বর্ণনা করিয়া প্রস্তাবের উপসংহার করা যাইতেছে।
কাল সম্বন্ধে মহাভারতে উক্ত আছে যে,--
বিধাতৃবিহিতং মার্গং ন কশ্চিদতিবর্ত্ততে।
কালমূলমিদং সর্ব্বং ভাবাভাবৌ সূখাসুখে ।।
কালঃ সৃজতি ভূতানি কালঃ সংহরতে প্রজাঃ।
সংহরন্তং প্রজাঃ কালঃ কালঃ শময়তে পুনঃ।।
কালোহি কুরুতে ভাবান্ সর্ব্বলোকে শুভাশুভান্।
কালঃ সংক্ষিপতে সর্ব্বাঃ প্রজা বিসৃজতে পুনঃ।।
কালঃ সুপ্তেষু জাগর্ত্তি কালোহি দুরতিক্রমঃ।
কালঃ সর্ব্বেষু ভূতেষু চরত্যবিধৃতঃ সমঃ।।
অতীতানাগতা ভাবা যে চ বর্ত্তন্তি সাম্প্রতম্।
তান্ কাল-নির্ম্মিতান্ বুর্দ্ধ্বা ন সংজ্ঞা হাতুমর্হসি।।
বঙ্গানুবাদ।-- পুত্রশোকার্ত্ত ধৃতরাষ্ট্রকে সঞ্জয় বলিতেছেন যে, হে মহারাজ! বিধাতার বিহিত পথ কেহই অতিক্রম করিতে পারে না। এ জগতের কি ভাব, কি অভাব, কি সুখ, কি দুঃখ সকলেরই মূল কাল । কাল ভূত সকলকে সৃষ্টি করে, কাল প্রজা সংহার করে, প্রজা-সংহারকারী কালকে কালই পুণরায় শামিত করে।
কালই সর্ব্বলোকে শুভাশুভ ভাবসমূহ করিয়া থাকে; কাল সমুদায় প্রজাকে সংক্ষেপ করে ও পুণরায় সৃষ্টি করে। জীবগণ সুপ্ত থাকিলেও কাল জাগিয়া থাকে, অতএব কালই দুরতিক্রম। কাল অবিধৃত ও সমভাবাপন্ন হইয়া সর্ব্বভূতে বিচরণ করে। কি অনাগত, কি বর্ত্তমান সকল ভাবকেই কাল-নির্ন্মিত বোধ করিয়া আপনি কখনও সংজ্ঞা ত্যাগ করিবেন না।
ফলতঃ, কালসংযোগ ব্যতিরেকে কিছুই উৎপন্ন, স্থিত বা নষ্ট হয় না। কালের সংঘটন না হইলে শুভ বা অশুভ কিছুই হইতে পারে না। সুতরাং কার্য্যসিদ্ধি সম্বন্ধে দৈব ও পুরুষকারের ন্যায় কালও অন্যতম প্রধান কারণ।
মনে কর, তুমি ভোজদ্রব্য সম্বন্ধে শুভাদৃষ্টসম্পন্ন, এবং পুরুষকার প্রভাবে তুমি সুখাদ্য বহু পরিমাণে সংগ্রহ করিয়াছ, কিন্তু তোমার বেলা ১১টার পূর্ব্বে আহারের অভ্যাস নাই বলিয়া তৎপূর্ব্বে ক্ষুধা উপস্থিত হয় না। এক্ষণে যদি তুমি ৭টার সময়ে আহার করিতে প্রবৃত্ত হও, তবে কিছুই আহার করিতে পারিবে না।
কারণ তখন ভোজনের কাল উপস্থিত হয় নাই। এইরূপ সর্ব্ব বিষয়েই কালের অপেক্ষা লক্ষিত হইবে। শস্যাদি উৎপাদন, বৃক্ষাদি রোপণ, মল মূত্রাদী পরিত্যাগ এবং সর্ব্বোচ্চ ব্যাপার জ্ঞান-ধর্ম্মাদি উপার্জ্জন পর্য্যন্ত সমস্তই উপযুক্ত সময় না হইলে হইতে পারে না। সুতরাং কাল যে পুরুষকার ও দৈব অপেক্ষা ও বলবান্, তাহাতে কোনও সন্দেহ নাই।
কর্ম্ম-ফল
দৈব ও পুরুষকারাদি বর্ণনকালে পুনঃ পুনঃ কর্ম্মফলের কথা লিখিত হইয়াছে। এ কারণ কর্ম্মফলটা যে কি, তাহা পরিস্ফুট করিতে চেষ্টা করা যাইতেছে।
কর্ম্ম শব্দে ক্রিয়া ও ক্রিয়াব্যাপ্য এই উভয়কে বুঝাইলেও এখানে উহা ক্রিয়ার্থক। আর ফল শব্দের অর্থ-- কোনও কার্য্য করিলে শেষে উহা যেভাবে পরিণত হয়, অর্থাৎ কার্য্যমাত্রের পরিণতি-জাত পদার্থই উহার ফল। বীজ বপন করিলে উহা বৃক্ষাকার ধারণপূর্ব্বক যদ্-রূপে পরিণত হয়, তাহাই উহার ফল।
শীতল জলে হস্ত নিক্ষেপ করিলে, শৈত্যানুভবই উহা ফল। সুতরাং সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, কর্ম্মফল অবশ্যই হইবে। এইরূপ যুক্তি যোজনা দ্বারা জানা যায় যে, অদৃষ্ট বলিয়া ইতঃপূর্ব্বে যে পদার্থের বর্ণনা করা হইয়াছে, কর্ম্মফলও তাহাই। সুতরাং অদৃষ্টবৎ উহাও ত্রিবিধ। কারণ কর্ম্মফলও অতিক্রম্য, দুরতিক্রম্য ও অনতিক্রম্য ভেদে তিন প্রকার।
এতদ্ভিন্ন সঞ্চিতরূপে অবস্থান ও ভোগার্থ-সমারম্ভ-রূপ ভেদে অদৃষ্ট (পূর্ব্বকর্ম্ম) বা কর্ম্মফল দ্বিবিধ। তন্মধ্যে সমারম্ভ-রূপ উত্থান দ্বারা এবং তদনুকুল কর্ম্মদ্বারা ঐহিক ফল প্রাপ্ত হইতে পারে। আর শাস্ত্রদ্বারাও তদনুসারে কর্ম্মদ্বারা স্বর্গমার্গ লাভ করিতে সমর্থ হয়। ফলতঃ দৈবাধীন ভোগ এবং কর্ম্মাধীন সঞ্চয়, ইহাই মহাত্মারা নির্দ্দেশ করেন।
-- ঈশ্বর গুরুনাথ সেনগুপ্ত।
0 মন্তব্যসমূহ