বিপরীত ভক্তি সাধনা কি ?



         বিপরীত ভক্তি সাধনা কি ?

        জগতে যত প্রকার সাধনা আছে, সকলই দুই প্রকার। যথা অনুকূলভাবে সাধনা বা অন্বয়ি-সাধনা এবং বিপরীতভাবে সাননা বা ব্যতিরেকি সাধনা। মনে করে, পানদোষাসক্ত ব্যক্তির পান দোষ দূর করিতে হইবে। ইহা দুই প্রকরে হইতে পারে প্রথমতঃ অল্প অল্প কমাইয়া ঐ দোষ ত্যাগ করান। 


দ্বিতীয়তঃ, ঐ দোষের অতি বৃদ্ধি দ্বারা ঐ দোষ পরিহার করান। এই দুইটির মধ্যে প্রথমটি অন্বয়ী সাধনা ও শেষটি ব্যতিরেকি- সাধনা। এইরূপ মনে কর, কোন ইন্দ্রিয়পরায়ণ ব্যক্তিকে কামদোষ হইতে নিবৃত্তি করিতে হইবে। উহাকে ও অল্পে অল্পে ঐ দোষ নিবারিত করা, বা একেবারে ঐ দোষের অতি বৃদ্ধি ঐ দোষের দোষত্ব প্রকৃতরূপে হৃদয়ঙ্গম করাইয়া উহা হইতে নিবৃত্তি করা আবশ্যক। এই দুইটীর মধ্যে, প্রথমটী অন্বয়ী সাধনা ও শেষটী ব্যতিরেকি সাধনা। 


  আবার, মনে কর, কাহাকেও সরলতা শিক্ষা দিতে হইবে। প্রথমে উহাকে আপন-পরিবার বর্গের সহিত সরল ব্যবহার, পরে প্রতিবেশীদিগের সহিত, এবং সর্ব্বশেষে নিখিল ব্রহ্মান্ডের সহিত সরল ব্যবহার, করিতে শিক্ষা দিয়া সরলতা শেখান যাইতে পারে। অথবা, কপটতার পরাকাষ্ঠায় উপনীত করিয়া ও তাহাকে সরল করা যাইতে পারে। উল্লিখিত সাধনাদ্বয়ের মধ্যে প্রথমটি অন্বয়িসাধনা ও শেষটী ব্যতিরেকি সাধনা। 


 উপরি উক্ত দৃষ্টান্তত্রয় হইতে ধর্ম্মার্থী অবশ্যই অন্বয়ি-ব্যতিরেকি-সাধনার মর্ম্ম বুঝিতে পারিয়াছেন এবং ইহাও জানিতে পারিয়াছেন যে, ব্যতিরেকি সাধনা অপেক্ষা অন্বয়ি সাধনা শ্রেষ্ঠ। সাধারণতঃ সত্যধর্ম্মাবলম্বীগণ অন্বয়ি সাধনায়দ্বারা গুণ সাধন করেন এবং যোগানুষ্ঠানকারিগণ ব্যতিরেকি-সাধনা দ্বারা গুণ সাধনা করিয়া থাকেন।


যদিচ শেষোক্ত পথাবলম্বীরা গুণসাধন যে করিতেছেন, তাহা অনুভব করিতে পারেন না, কিন্তু, অনন্ত মঙ্গলময়ের রাজ্যে মঙ্গল ভিন্ন অমঙ্গল না থাকায় উঁহারাও কালে গুণ সাধনার মর্ম্ম বুঝতে সমর্থ হইবেন।( ইহকালে না হইলেও পরলোকে হইবেন, সন্দেহ নাই)।


এক্ষণে বক্তব্য এই যে, যে সকল ব্যক্তি স্ব-কৃত পূর্ব্বকর্ম্মানুসারে এরূপ অবস্থায় পতিত হয় যে, অন্বয়ি সাধনা আর তাহাদিগের ক্ষমতাধীন নহে, তাহাদিগের পক্ষেই ব্যতিরেকি সাধনা কর্ত্তব্য। ভক্তিবিষয়েও এইরূপ।


স্ব-কার্য্যদোষে যাহারা  প্রথমে নৈসর্গিক ভক্তিভাজন মাতা ও পিতার প্রতি ভক্তি করিতে সমর্থ হয় না, তাঁহাদিগের স্নেহের, বা ভক্তিহীনতানিবন্ধন ভক্তিবিষয়ক দৃষ্টান্তের, অভাবপ্রযুক্ত মাতৃভক্তি ও পিতৃভক্তি সাধন করিতে পারে না এবং তাঁহাদিগের প্রতি অভক্তির পরাকাষ্ঠা প্রাপ্ত হয়, তাহাদিগের কর্ত্তব্য এই যে বিপরীতভাবে ভক্তিসাধনা করে, অর্থাৎ, দীক্ষাদাতা গুরু বা পারলৌকিক মহাত্মাদিগের প্রতি প্রথমে ভক্তি করত আরম্ভ করে। 


 এই ভক্তি করা অতি কঠিন নেহ, কারণ, বিবধ গুণসম্পন্ন মহাত্মার প্রতি স্বাভাবিক নিয়মে গুণাকর্ষণে আকৃষ্ট হৃদয় সহজেই ভক্তিরসে আদ্র হইয়া ধাবিত হইতে পারে। বিশেষতঃ ঐ সকল মহাত্মার নিঃস্বার্থ স্নেহভাব দর্শন করিলে এবং তাঁহাদিগের হৃদয় ঈশ্বরভক্তিতে কিরূপ সমুজ্জল, তাহা অনুভব করিতে পারিলে, সহজেই ভক্তির উদয় হয়।


এইরূপ গুরুর প্রতি ভক্তি করিয়া ভক্তিসাধনা আরম্ভ হইলে, এবং হৃদয় ভক্তিরসে আদ্র হইলে, সহজেই স্বার্থপরতাকে বিসর্জ্জন দিয়া মাতা ও পিতার প্রতি ভক্তি করিতে পারা যায় ইহাকেই বিপরীতভাবে ভক্তি সাধনা বা ব্যতিরেকি ভক্তিসানধা কহে।


         এক্ষণে জিজ্ঞাস্য হইতে পারে যে , ১মতঃ যে ব্যক্তির ধর্ম্মবিষয়ে প্রবৃত্তি নাই, যে নিরন্তর পাপকার্য্যে রত, পাপ করিতে করিতে অবশেষে সে কিরূপে ধর্ম্মপথে আসিবে? ২য়ঃ, যাহার ভক্তি নাই এবং যে অভক্তির পরাকষ্ঠায় উপনীত হইয়াছে, সে কিরূপে ভক্তির প্রার্থী হইবে ? এবং ৩য়ঃ, যে ব্যক্তি মাতাপিতার প্রতি অভক্তির পরাকাষ্ঠা প্রাপ্ত হইল, সে কিরূপে গুরুর প্রতি ভক্তি করিতে পারিবে? এই প্রশ্নত্রয়ের উত্তরদান অত্যাবশ্যক বিবেচনায় ক্রমশঃ উত্তর প্রদত্ত হইতেছে।


       আমাদিগেকে প্রথমতঃ স্বীকার করিতে হইবে যে, অনন্ত-করুণাময় জগদীশ্বর আমাদিগকে স্বাধীনতা প্রদানপূর্ব্বক যে সকল মনোবৃত্তি দিয়াছেন, তৎসমুদায় দ্বারা পাপ ও পুণ্য উভয়ই সম্পূন্ন হইতে পারে। দেখ, পরদুঃখ হরণেচ্ছা দ্বারা যেমন পুণ্য সঞ্চয় হইতে পারে, তদ্রূপ পরের সামান্য দুঃখ দূর করিবার জন্য আত্মহত্যা স্বীকার করিলে উহাতে ঘোরতর পাপও হইতে পারে। এইরূপে কাম দ্বারা যেমন পাপ হইতে পারে, তেমনই উহার প্রকৃত ব্যবহার দ্বারা জীবপ্রবাহ রক্ষা প্রভৃতি বহুপুণ্যও হইতে পারে। এ বিষয়ে আর দৃষ্টান্ত দ্বারা প্রস্তাব বাহুল্য করা নিস্প্রয়োজন।


      আমাদিগকে দ্বিতীয়তঃ স্বীকার করিতে হইবে যে, "মানবমন অত্যন্ত কার্য্যপ্রবণ, কোনরূপ কার্য্য না করিয়া উহা থাকিতে পারে না।" আপন আপন মনের প্রতি লক্ষ্য করিলে এবিষয়টি সহজেই প্রতীয়মান হইবে। 


    আমাদিগকে তৃতীয়তঃ স্বীকার করিতে হইবে যে, "কার্য্যের অত্যন্ত বৃদ্ধি হইলে উহার কারণগুলির অবসাদ হয়, এবং কার্য্যের পরাকাষ্ঠা হইলে, কার্য্যের কারণগুলিরও অবসাদের পরাকাষ্ঠা হয়, অর্থাৎ, উহাদিগের দ্বারা কর্য্য করিতে একেবারে অসমর্থ হইতে হয়।" মনে কর, তুমি হস্তপদাদি সঞ্চালন করিয়া শারীরিক পরিশ্রম করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছ। 


যখন ঐ পরিশ্রম অত্যন্ত বর্দ্ধিত হইবে, তখন হস্তপদাদিরও অবসন্ন হইয়া আসিবে। আর যখন ঐ পরিশ্রমের পরাকাষ্ঠা হইবে, তখন হস্তপদাদিরও অবসাদের পরাকাষ্ঠা হইবে, অর্থাৎ, তুমি উহাদিগের দ্বারা কার্য্য করিতে অসমর্থ হইবে।


       অপিচ, আমাদিগকে চতুর্থতঃ স্বীকার করিতে হইবে যে, "যাহা আমাদিগের ছিল, তাহার অত্যন্ত অভাব হইলে আমরা তাহার জন্য হাহাকার করি ও তাহা পাইবার জন্য স্বতঃই উপায় অবলম্বনে প্রবৃত্ত হই, অথবা, যে যে পদার্থ আমাদিগের প্রাপ্য বলিয়া জানি, তৎসমুদায়ের কিঞ্চিন্মাত্রও না পাইলে অত্যন্ত ব্যাকুল হই এবং প্রাপ্তির উপায় আশ্রয় করিয়া উহা পাইতে চেষ্টা করি।" 


 মনে কর, যাহার পুত্রকন্যাদি ছিল, সে যদি দৈবদুর্বিপাকে সমস্ত সন্তান বিহীন হয়, তবে সে অবশ্যই হাহাকার করে ও সন্তান-প্রাপ্তির জন্য পুনরায় চেষ্টায় প্রবৃত্ত হয় এবং যাহার কখনও সন্তান হয় নাই, সে যদি জানিতে পারে যে, সন্তান না হইলে পরলোকে অশেষ যন্ত্রণা ভোগ করিতে হইবে, তবে সেও হাহাকার করে বা অত্যন্ত অভাব সহকারে পুত্রপ্রাপ্তির উপায় অবলম্বনে প্রবৃত্ত হয়। 


     এক্ষণে বিবেচনা করিয়া দেখ, যে ব্যক্তি অধর্ম্মকার্য্য করিতে করিতে অধর্ম্মের পরাকাষ্ঠাপ্রাপ্ত হইয়াছে, তাহার অধর্ম্মসাধনী বৃত্তিগুলি অবশ্যই কার্য্যক্ষম হইবে, আবার মন কার্য্য না করিয়া থাকিতে পারে না, সুতরাং সে ধর্ম্ম ভিন্ন আর কি আশ্রয় করিবে? এইটী  ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার (Action and Reaction) ন্যায় তাহার ধর্ম্মকার্য্য সাধনের মূল। অথবা প্রবৃত্তির নিবৃত্তি হইলেই পুনরায় ব্যতিরেকমুখী হইয়া যাইবে। এইরূপেই (১মতঃ) অতশয় অধর্ম্মচারিগণ ধর্ম্মকার্য্যে প্রবত্ত হয়।


       অপর, যাহারা ভক্তির কণামাত্র লাভ করিয়াও অভক্তির পরাকাষ্ঠা প্রাপ্ত হইয়াছে, তাহারাও ৪র্থ স্বীকৃতের ১ম অংশ অনুসারে ভক্তির জন্য ব্যাকুল হইবে। আর যাহারা জন্মাবধি ভক্তির মুখ দেখে নাই এবং কার্য্যদোষে অভক্তির পরাকাষ্ঠায় উপনীত হইয়াছে, তাহারও ৪র্থ স্বীকৃতের ২য় অংশ অনুসারে, ভক্তি করা তাহাদিগের উচিত বলিয়া যখন জানিতে পারবে, তখন উহার জন্য ব্যাকুল হইবে এবং উহা পাইবার উপায় আশ্রয় করিয়া, তাহা পাইতে চেষ্টা করিবে।


        এখন দেখ, যে যখন ভক্তির প্রার্থী হইবে, তখনই সে ধর্ম্মপথ অবলম্বন করিবে এবং ধর্ম্মপথ অবলম্বন করিয়া যখন দেখিতে পাইবে যে, একেবারে ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি করা অসাধ্য, তখনই গুরুর প্রতি ভক্তি করিতে প্রবৃত্ত হইবে । এইরূপেই (২ য়তঃ) যাহার ভক্তি নাই ও যে অভক্তির পরাকাষ্ঠা প্রাপ্ত হইয়াছে, সে ভক্তির প্রার্থী হয় এবং এইরূপেই (৩য়তঃ) যে ব্যক্তি মাতাপিতার প্রতি অভক্তির পরাকাষ্ঠা প্রাপ্ত হইয়াছে, সে গুরুর প্রতি ভক্তি করিতে পারে।

              — ঈশ্বর গুরুনাথ সেনগুপ্ত।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ