সত্য ধর্ম্ম অবলম্বীগণ নিরাকার পরমপিতার উপাসক।
সত্যধর্ম্মালম্বীদের উপাসনার সময়ে প্রতীকি রূপে প্রণব রাখাই কর্ত্তব্য।
এই বিশুদ্ধ ধর্ম্মের মতে সাকার উপাসনা নাই, যোগ-সাধন নাই, জাতিভেদ নাই, এবং নির্ব্বাণ ( ঈশ্বরে লীন হওয়া ) নাই। ইহার মতে গুণসাধন সর্বপ্রধান কার্য্য । সুতরাং ঈশ্বরোপাসনা ও গুণের অভ্যাস একমাত্র কার্য্য। এই ধর্ম্মানুসারে জগতে সমস্ত নরনারীকে সহোদর ও সহোদরার ন্যায় জ্ঞান করিতে হয়,এই অভেদ ভাব অবশেষে সমস্ত চেতন পদার্থে পরিণত হয়। এই ধর্ম্ম অবলম্বনার্থে হিন্দুশাস্ত্রোক্ত চতুর্ব্বিধ আশ্রমের বিশেষ কোন আশ্রম প্রয়োজনীয় নহে, সকল আশ্রমই ইহা অবলম্বন করিতে পারেন। সত্য-ধর্ম্মের আশ্রম হৃদয়, যাহাতে পরমাত্মা আসীন থাকেন।"আশ্রম গ্রহণ কর" বলিলে বুঝিতে হইবে যে, হৃদয়ে জগদীশ্বরকে স্থান দেও। যে নিরাশ্রমী , তাহার হৃদয় নাই, তাহাতে পরমাত্মা বসিতে পারেন না, কেবল উপরি উপরি রক্ষা করেন, কিন্তু পরিত্যাগ করেন না। -সত্যধর্ম্ম
মূল কথা গুণ পদার্থ যখন দৃশ্যমান নহে, অনুভূতি দ্বারা প্রকাশ্যমান এবং বহু গুণের সমষ্টিগত অবস্থাই দৃশ্যমান। তখন বীজরূপ গুণকে অবলম্বন করিয়া বহু গুণের সিঞ্চনের মাধ্যমে পরমপিতাকে অন্তরে দৃশ্যমান করানোই প্রধান কাজ। ইহাই পরমপিতার দর্শন।
সাকার উপাসনা-পরমপিতা জড় জগতের সহিত তাঁহার অংশ সংযুক্ত করিয়াছেন, কিন্তু তিনি ঐ সৃষ্টি হইতে নির্লিপ্তভাবে বিভিন্ন আছেন, সুতরাং আকার-বিশিষ্ট যাহাই ধর না কেন, তাহাই জড় জগতের সহিত সংযুক্ত হইবেই হইবে। এজন্য উহা কখনই সেই অনন্তশক্তি অনাদি অনন্ত নহে। অতএব আকার বিশিষ্ট বা সাকারের উপাসনা করিলে কখনই পরমপিতা পরমেশ্বরের উপাসনা করা হয় না। এ নিমিত্ত সহজেই সপ্রমাণ হইতেছে যে, সাকার উপাসনা কর্ত্তব্য নহে।(সত্যধর্ম্ম) ইহার পর সত্যধর্ম্মালম্বিগণ কোন দিকে ধাবিত হইতেছি , একবারটি ভাবুন।
সত্যধর্ম্ম অবলম্বীগণ নিরাকার-বাদী সাকার-বাদী নহে । কেহ যদি বাহির হইতে দেখেন তাহার মনে হইবে যে ইহারা সাকার বাদী, কেননা উপাসনা কালে গুরুদেবের ছবি রাখিয়া কার্য্য করিতেছে। ইহারি কারণবশত বৃহৎ পাপের ভাগী হইয়া পরিতেছে, তাহা কেন? তাহারি প্রমাণ স্বরূপ পাপের কারণ দর্শাইতেছি। প্রতিটি উৎসবে, এই মহান যজ্ঞে নিজেদের আহুতী দিবার নিমিত্তেই সকলে উপনিত হয়। যাহাতে গুরুদেবের সহীত দেবদেবীদের সঙ্গ লাভ করিয়া নিস্পাপ হইতে এবং শিক্ষা লাভ করিতে সকলেই আসে, কিন্তু সঙ্গে করিয়া স্থূলের সুক্ষ্ম পাপ লইয়া গৃহে ফিরিতে হয়, কতোদিন এই বোঝা লয়াই বেড়াইবে ???
প্রতিটি উৎসবে দেখিয়াছেন যে, বাহিরের অন্যান্য ভক্ত পিপাষু ব্যক্তিগণ আসিয়া তিনি না বুঝিয়া সষ্টাঙ্গে প্রণাম করেন,(তাহার প্রণাম করা ন্যায় সঙ্গত) কেহ কেহ কিছু অর্থ বা উপকরণ (মিষ্টি) গুরুদেবের আসনে দিয়া থাকেন, কিছুবা সময় বসেন আবার কিছুবা ভক্তপ্রাণ মানুষ সর্ব্ব অবস্থা এবং সঙ্গীত না বুঝিয়া চলিয়া যান (বুঝুক বা নাই বুঝুক তিনি কিন্তু পুণ্য নিয়াই ফিরিলেন) । প্রায়শই এই অবস্থা ঘটিয়া থাকে ।কারণ তিনি অনুমান করিয়া লন যে, ইহারা ঐ মহাত্মা গণের ভজনা করিতেছেন, তাই তিনি উপকরণ অথবা অর্থ দিয়া চলিয়া যাণ। সত্যধর্ম্ম অবলম্বীগণ কি, তাহা করেন? একটু ভাবুন! দুই একজনকে হয়তো বোঝাইতে পারা গেল কিন্তু বেশি সংখ্যক ভক্তপ্রাণ মানুষ কে বোঝাইবার অবকাশ থাকে না। আবার একজন বোবা ভক্তপ্রাণ মানুষ আসেন তাহাকে কি করিয়া বোঝাবেন?
তাহারা সকলেই কিন্তু নিজেরা পুণ্য লইয়া আমাদের পাপের ভাগী বানাইয়া চলিয়া যান। কিন্তু যদি ঐ স্থানে গুরুদেবের ছবি না রাখিয়া যদি একটি প্রণবের ছবি রাখিয়া উপাসনা হইত, তাহা হইলে অনন্তঃ এই মহা পাপের ভাগী হইতে হয় না। কেননা তিনি প্রণব দেখিয়া যদি ভাবেন যে, উহারা প্রণবের ভজনা করিতেছি, (তাহাইতো সত্য, যে অনন্ত অনন্ত অনন্ত গুণময় পরমপিতার গুণকীর্ত্তনই করিতেছে।) উহাইতো সত্য তাহাতে অনন্তঃ ঐ মহা পাপে তো পতিত হইতে হইবে না। ইহাতে সকল ভক্তপ্রাণ মানুষের প্রশ্ন করিবার একটি অবকাশ তৈরী হইয়া থাকে। কিন্তু উহা হইতেও অবচেতন মনে বঞ্চিত করিয়া ফেলিতেছি। ইহাতে সত্যধর্ম্ম প্রচারের বাধা হইয়া দাঁড়াইতেছে।
গুরুদেব বলিয়াছেন " সাকার আর নিরাকার দ্বন্দ্বেতে পোড়া সংসার, এ বিবাদ ভঞ্জন করে, সাধ্য আছে আর কার?" আমারাই যদি গুরুদেব কে কোথায় রাখিতে হইবে এই বিবাদ করিয়া বসি, তাহা হইলে অন্যদের ভঞ্জন কি করিয়া করিবো একবারটি ভাবুন? সত্যধর্ম্ম জগৎ বাসীর উদ্ধারের নিমিত্ত আসিয়াছে সর্বপ্রথমে নিজেদের সর্ব্ব অবস্থায় নিরাকারত্বের উপাসনা করি তাহা যেন বাহিরেও প্রকাশ পায়। ইহা আমাদের মনে প্রাণে বাধিয়া রাখিতে হইবে। সত্যধর্ম্ম প্রচার করিব কিন্তু নিজেদের মধ্যেই যদি গলদ থাকিয়া যায় তাহা হইলে কি করিয়া প্রসাদ লাভ ইহবে ।
উপাসনার সময় কি চোখ খুলিয়া রাখা উচিত? নিশ্চয় না। যদি চোখ বন্ধই থাকে তাহা হইলে গুরুদেবের ছবি বা প্রণব আছে, ইহাতে কি আইসে যায় ? উপাসনার সময় যদি গুরুদেবের ছবির দিকে তাকানো হইয়া থাকে তাহা হইলে পরমপাতার গুণের প্রতি একাগ্রতা ভঙ্গ হইয়া যায়। ইহা না করিয়া যদি উপাসনার সময় আমরা মনে করিয়া বসি যে, গুরুদেব আমার হৃদয় মন্দিরে আছেন এবং আমার পাশে ও আছেন, এখন আমার উপাসনার দিকে একাগ্র হওয়া উচিত । তাহাই করিবার প্রয়োজন।
পারলৌকিক মহাত্মাগণ ও গুরুদেব বার বার বলিয়াছেন অন্যান্য ধর্ম্মের অঘটনের কথা যে, কি করিয়া অন্যান্য ধর্ম্ম নিরাকারত্বের কথা বলিয়া, পরিশেষে সাকারত্বে পরিণত হইয়া গিয়াছে। আমরা ও সেই দিকে ধাবিত হইতেছি কিনো? এই অঘটন কোন না কোন জায়গায় ঘটিয়া গিয়াছে । একটি বাড়ির কথা শুনছিলাম। উপাসনার সময় গুরুদেবের ছবি রাখিয়া তাহার সন্মুখে উপকরণ সাজাইয়া তাহা সমাপ্ত করিলেন এবং সেই স্থানে গুরুপূজা হয় নাই । ইহা ঘটিয়াছিল সত্যধর্ম্মের স্বনামধন্য পন্ডিত ব্যাক্তির মৃত্যুকে উপলক্ষ করিয়া। আমাদের এ হেন আচরনের জন্য গুরুদেব কতো যে ব্যথিত হইয়াছেন তাহা বলিবার নহে।
সত্যধর্ম্মে ঐ দূর্গতি যাহাতে না হয়, ইহারই জন্য গুরুদেব ছবি তুলিতে চান নাই। মহাত্মা সীতানাথ ও মহাত্মা নিবারণ অনেক অনুরোধ করিয়া বলিলেন, "আমরা তো আপনাকে দেখলাম, গুরুধ্যান করিতে পারিব কিন্তু আপনার অবর্তমানতায় ভবিষ্যতে যাহারা সত্যধর্ম্মে আসিবে তাহারা কি করিয়া গুরুধ্যান করিবে?" অনেক অনুরোধের পর রাজি হন। গুরুদেবের ছবিটি কি সন্মুখে রাখিয়া উপাসনা করিবার জন্য? নাকি গুরুপূজার সময় রাখিবার প্রয়োজনে, গুরুধ্যানের নিমিত্ত ছবিটি তোলা হইয়া ছিল, উপাসনার সময় গুরুধ্যান করিবার জন্য কি? গুরুদেব তত্ত্বজ্ঞান গ্রন্থে বারংবার সাকারের দিকে ধাবিত হইতে নিষেধ করিয়াছেন।
গুরুদেব যখন স্বশরীরে ছিলেন তখন কি করিয়া উপাসনা হইতো? একবারটি ভাবুন! তাহার সামনে কি কোনও ছবি রাখতেন, নাকি ফাঁকা থাকিত? উপাসনার সময়ে গুরুদেবের ছবি যদি রাখিতেই হয় তাহা হইলে আমারা, যেই দিকে মুখ করিয়া বসিব, ঠিক আমাদের সম্মুখে গুরুদেবের ছবিটি পেছন করিয়া রাখিতে হয়, কেননা গুরুদেব স্বশরীরে থাকাকালীন, উপাসনার সময় যদি পূর্ব্ব-মূখী হইয়া বসিতেন, সকলে তাহার পেছনে বসিয়াই উপাসনা সমাপ্ত করিতেন। তখন কি তিনি ঐ রূপ আসনে বসিতেন? সকলে তাঁহার দিকে মুখ করিয়া বসিয়া উপাসনা করিতেন? এইরূপ হয় নাই। তাহা হইলে কেন আমরা এই দূর্ব্বিসহ অবস্থায় পড়িয়া থাকিব! ইহাতো করিতে বলেন নাই। তাহাকে আহ্বানের সহিত হৃদয় আসনে ধারন করিয়া উপাসনা করাই কর্ত্তব্য ।
কেহ কেহ বলিতে পারেন গুরুদেবের ছবিটি সন্মুখে থাকিলে একাগ্রতা হয়। (কেননা তিনি বলিয়াছেন, "গুরুধ্যানের প্রভাবে পরমপিতার ধ্যানে নিমগ্ন হইতে পারিবে।"। ইহাতে কি প্রমান হয় ছবিটি রাখা তাহারই সম্মতি।) তাহা হইলে একবারটি গুরুদেবের ছবিটি ছাড়া , মনে মনে ভাবুন আমার অন্তরে ও বাহিরে গুরুদেব আছেন এবং উপাসনা করুন দেখিতে পাইবেন উপাসনায় আরো একাগ্র হইতে পারিতেছেন।
বাংলাদেশে ২০০৪ সালের শিশিরোৎসবে, সাধক দিলীপ বাবু শাস্ত্রপাঠে দাঁড়াইয়া বলিয়াছিলেন যে, ২০১২ সালের পূর্বে ছবি নিয়া কোন কথা হইবে না ( কোন একজনার প্রশ্নের উত্তরে)। তাহার এই উপলব্ধি হইয়া ছিল যে, তাঁহার প্রয়োজন হইবে নিশ্চয় তাহা আগত।
গুরুদেব পরলোকগত হইবার পর যেরূপ সঙ্কট হইয়া ছিল, তাহা উপাসনার ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হইয়াছে, এক্ষনে তাহার পুনরুক্তি হইল না। এতকাল পর ২০১৪ সাল হইতে এখানে গুরুদেবের ছবি না রাখিয়া প্রণব রাখিয়া উৎসবাদী পরিচালিত হইতেছে।
এবং আর্শীবাদের অধিবেশন শেষ হইবার পর গুরুদেরকে সারম্বরে বরণ করিতে করিতে আসনে রাখিয়া আমরা গুরুপূজা করিয়া থাকি। ২০১৫ সালের শিশিরোৎসবে পারলৌকিক মহাত্মাগণ জানাইয়া গিয়াছিলেন যে তোমরা এখন হইতে গুরুদেবকে সারম্বরে বরণ করিতে করিতে আসনে বসাইবে।বরণের বিষয় গুরুদের সাধনা গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করিয়াছেন যে "গুরুকে দেখিয়া তাঁহাকে তিনবার প্রদক্ষিণ করিবে এবং দক্ষিণ হস্তদ্বারা গুরুদেবের পাদপদ্ম স্পর্শ করিয়া পুনরায় প্রদক্ষিণ করিয়া নমস্কার করিবে।" ইহা তাহার পর হইতে ঐ ভাবেই যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়া চলিতেছি।
তাই আপনাদের সাদর আমন্ত্রণ জানাই আপনারাও গুরুদেবের ইচ্ছাকে পাথেয় করিয়া নিরাকারত্বের পথে সুচারু রূপে চলিয়া আত্ম উন্নতির পথের দিশা নির্ণয় করুন।
- আদিষ্ট নিরুপম।
- আদিষ্ট নিরুপম।
0 মন্তব্যসমূহ