গুরু গীতা ব্যাখ্যা।



    গুরু গীতা

    গুরুদেব গুরুগীতা লিখিবার পর নিজের সম্বন্ধে বলিয়াছেন এই যে,

    "দর্শয়িতুং গুরোঃ শক্তিং স্বশীষ্যে ভক্তিসংযুতে।
    ত্রাতুরধনকামস্য গুরু- ময়োদিতা।।"

অর্থাৎ, দেখাইতেছি গুরুর শক্তি, আমার শিষ্যকে ভক্তির সহিত যুক্ত হইতে। ত্রাণকারী, ধনকামনা বিহীন গুরু-গীতা আমার প্রদত্ত্ব।।


    সুচনা-

 ১)     যত্নপাশ, স্থিরচিত্তদন্ড যোগ করি,
         অশেষ শাসনরূপ মথিয়া সাগরে ।
         পরম পদার্থ জ্ঞানসুধা দানকারী
         অচিন্ত্যশকতি তুমি,প্রণমি তোমারে ।।

     অসীম অপরূপ নিয়ম (আইন রূপ ) মহাসাগর মন্থনের দ্বারা ( অবলম্বন ) অষ্টপাশ-ষড়রিপুকে বাধিয়া চিত্তকে স্থির করিয়া তোমার সহিত যুক্ত ( গুণের সহিত বাস ) করিলে পরম  জ্ঞান পদার্থ জ্ঞানসুধা রত্ন দান করিয়া থাক, তুমি চিন্তাশক্তির অতীত, তোমাকে প্রণাম করি ।


২)       সমুদায় শাস্ত্র আর মতভেদ যত,
          বিপরীত ভাবময় ধর্ম্মচয় আর।
          করিলা আপনগুণে সব একীকৃত,
         অচিন্ত্য শকতি তুমি, প্রণমি আবার ।।

      হে নাথ সর্ব্ব শাস্ত্রে যত মতভেদ আছে, তাহা তুমি দূর কর সত্যস্বরূপে, সেই ধর্ম্মকম্মে যে সব বিপরীত ভাব অবস্থা আছে তাহাও তুমি মোচন কর তোমার প্রেমের দ্বারা । নিজ গুণে সকলকে একই সূত্রে প্রেম গুণকণার মাধ্যমে বাঁধিয়া রাখিয়াছ,ইহা চিন্তা শক্তির অতীত, তোমাকে প্রণাম ।


৩)  জ্ঞান, প্রেম, ভক্তি, দয়া, কৃপাদি, করুণা,
      সম-দরশন, আর বিশ্বাস ঋজুতা,
      মহাত্মতা, নির্ভরতা, অভেদবেদনা,
      ক্ষুধাহীন-তৃষ্ণা হীন-নিদ্রারহিততা।


     তুমি জ্ঞান, প্রেম, ভক্তি, দয়া, কৃপাদি ও করুণা গুণের দ্বারা সরলান্তকারণে দৃঢ়বিশ্বাস সহযোগে সমদর্শনে (ঈশ্বরমগ্ন যেমন গুরুমগ্ন) রহ, ঐ সাধনার মাহাত্ব্য এই যে তাহাতে নির্ভরতা সহকারে কষ্টশ্বিকার পূর্ব্বক দূর্ভেদ্য-দূস্তর পথ চলিয়া ক্ষুধাহীন, তৃষ্ণাহীন ও নিদ্রারহীত অবস্থায় পরিণত হইয়া আছ।


 ৪)     দূরশ্রতি,দুরদৃষ্টি আর গুণ যত
         প্রচুর তোমাতে রহে গুরো ! অবিরত। 
         প্রণিপাত প্রণিপাত করি বার বার,
         অচিন্ত্যশকতি তুমি চরণে তোমার ।।

      গুরুদেব তোমার কাছে দূরশ্রুতি, দূরদৃষ্টি এবং আর বহুগুণে বিভূষিত হইয়া আছ । তুমি চিন্তা শক্তির অতীত তোমাকে প্রণাম করি বার বার প্রণাম করি ঐ চরণে। 


৫)     গুরুদেব! তুমি মম রক্ষক তারক,
        গুরুদেব! তুমি মম উন্নতি সাধক।
        অনন্ত ভাবতে আমি অনন্ত অধীন
        অচিন্ত্য শকতি! তোমা নমে এই দীন।।

      গুরুদেব তুমি আমাকে প্রতি মুহুর্তে রক্ষা করিতেছে, গুরুদেব তুমি মোরে উদ্ধার করিবার জন্য অর্থাৎ ঈশ্বর দর্শন করাইবার জন্য ব্যাকুল। আমি যে অনন্ত ভাবে ভাবিতে পারিয়াছি তাহা তোমারি দয়ায়, তাহা চিন্তা শক্তির অতীত ! তোমাকে প্রণাম এই দীন হীনের।

        
৬)     প্রসন্ন হইলে তুমি, প্রসন্ন ভুবন,
        সুরাসুর সবে হেরি প্রসন্ন তখন।
        কুপিত হইলে তুমি ক্রোধময় সব,
        প্রণিপাত করি তোমা, অচিন্ত্য-বিভব। 

       তুমি যখন আমার প্রতি প্রশন্ন হও, যখন আমি ঈশ্বর মগ্ন হই, তখন জগতের যাহা কিছু দেখিতে পাই তাহা ছাড়াও যাঁহারা দেবতা ও দানব সকলেই আমার প্রতি প্রসন্ন হয়। আর তুমি যখন ক্রদ্ধ হও যেদিকে তাকাই সকলই ক্রোধময় অবস্থায় দেখিতে পাই, তাহা অপূর্ব্ব এবং চিন্তার অতীত রূপ ঐশর্য্য, তোমাকে প্রণাম করি ।



৭)    কাশি হয়, তব পদ যেই স্থানে রয়,
       দয়াকণা তব যথা তাহা গয়া হয়।
       গুণের কীর্ত্তন গুরো ! যথা তব হয়,
       সমুদয় তীর্থ তথা হয় সুনিশ্চয়।।

      তোমার চরণ যেখানে পরে, সেই স্থান বারাণসী ধামে পরিণত হয়, তোমার এক বিন্দু দয়ায় গয়ার ন্যয় মুক্তি পায়। গুরুদেব তোমার গুণকীর্ত্তন যেই স্থানে হয়, নিশ্চিত সেই স্থান সকল পূর্ণ পবিত্র তীর্থে পরিনত হয়।

   
 ৮)    নমি তোমা, নমি তোমা, নমি বার বার,
        নমি প্রভু  তব পদে দেবেশ আবার। 
       যে তুমি করুণাগুণে শিক্ষক আমার 
       সকল বিষয়ে গুরু! নমি বার বার।


       তোমাতে নত, প্রণাম তোমারে, বারংবার প্রণাম করি, নমি প্রভু, হে দেবেরও দেব তোমার চরণে আছি। যে করুণার গুণে তুমি শিক্ষক আমার, (ঈশ্বর প্রাপ্তির মূখ্য পরিচালক) সকল বিষয়ে প্রধান ! নমি বার বার ।


৯)      প্রণিপাত প্রণিপাত করি বার বার,
         নমি প্রভু তব পদে দেবেশ আবার। 
         যে তুমি মাতার রূপ করিয়া ধারণ 
         আপন করুণাগুণে করেছ পালন। 

       প্রাণের সহিত প্রণাম করি বার বার প্রণতি, হে দেবেশ্বর তোমার চরণে আছি।মাতৃ মমতা গুণে আমাকে সর্ব্বক্ষণ কোলে করিয়া আছ এবং নিজ করুণাগুণে আমায়  পালন করিতেছ। (পরম আদরের সহিত পালিছ, যাহাতে আত্মসুখ মুক্তি লভিবারে পাই।) 


১০)     প্রণিপাত প্রণিপাত করি বার বার
        নমি প্রভু তব পদে দেবেশ আবার।
        যে তুমি পিতার রূপ করিয়া ধারণ
        আপন করুনাগুণে করেছ সৃজন।।

      ‌  প্রাণের সহিত প্রণাম করি বার বার প্রণাম, হে দেবেরও দেব তোমার চরণে আছি। পিতৃ স্নেহরূপে তুমি ধরিয়া আছ এবং নিজ করুনাগুণে সৃষ্টি (আবিষ্কার) করিয়াছ মোরে । ( পরম জন্ম তোমা হইতেই পাইয়াছি।) 


১১)       প্রণিপাত শ্রচরণে করি বার বার,
          নমি প্রভু তব পদে দেবেশ আবার।
          যে তুমি পত্নীর রূপ ধরিয়া ললিত
          আপন করুণাগুণে করেছ মোহিত।।

       তোমার ঐ সুন্দর চরণে বার প্রণাম করিতেছি, হে দেবেশ্বর তোমার চরণে পড়ে আছি। তুমি পত্নীর (পতির) রূপ ধারণ করিয়া প্রেমাকর্ষিত করিতেছ এবং নিজ করুণাগুণে তাহাতে মোহিতও করিতছ।


১২)      প্রণিপাত শ্রীচরণে করি বার বার
           নমি প্রভু তব পদে দেবেশ আবার।
           যে তুমি পুত্রের রূপ করিয়া ধারণ
           আপন করুণাগুণে হয়েছ নন্দন।।

       তোমার ঐ সুন্দর চরণে বার বার প্রণাম করিতেছি, হে দেবেরও দেব তোমার চরণে পড়ে আছি। তুমি পুত্র রূপে আমাকে ধরা দিয়া আছ, হে আনন্দময় তুমি নিজ করুণাগুণে প্রতি মূহুর্ত্তে আনন্দ প্রদান করিতেছ। 


১৩)       প্রণিপাত শ্রীচরণে করি বার বার
            নমি প্রভু তব পদে দেবেশ আবার।
            যে তুমি কন্যার রূপ করিয়া ধারন
            ‌নিজ দয়া গুণে শান্তি কর বিতরণ।

        তোমার ঐ সুন্দর চরণে বার বার প্রণাম করিতেছি, হে দেবেরও দেব তোমার চরণে পড়ে আছি । তুমি কন্যার রূপ ধরিয়া আছ আমার কাছে ও নিজ দয়াগুণে শান্তি প্রদান করিতেছ। (যেমন কন্যারূপি শান্তি প্রদানিছ।)


১৪)      প্রণিপাত শ্রীচরণে করি বার বার,   
            নমি প্রভু তব পদে দেবেশ আবার।
            যে তুমি বন্ধুর রূপ করিয়া ধারণ
            নিজ দয়াগুণে সুখ কর বিতরণ ।।


      তোমার ঐ সুন্দর চরণে বার বার প্রণাম করিতেছি, হে দেবেরও দেব তোমার চরণে পড়ে আছি। তুমি বন্ধুর রূপ ধারণ করিয়া আছ আমার কাছে ও নিজ দয়াগুণে তাহাতে সুখ দিয়া যাইতেছ। (যেমন বন্ধন সুখ প্রদানিছ।)


১৫)    প্রণিপাত শ্রীচরণে করি বার বার,
          নমি প্রভু তব পদে দেবেশ আবার।               যে তুমি করুনা করি অভেদ ভুবনে,
           ভেদ ভাব দান কর নিজ দয়া গুণে।।

      তোমার ঐ সুন্দর চরণে বার বার প্রণাম করিতেছি, হে দেবেশ্বর তোমার চরণে পড়ে আছি। করুণাগুণে তুমি এই সুন্দর ভুবনে (পৃথিবীময়ে) অভেদ ( গুণের মধ্যে মিলেমিশে ) থেকে ও নিজ দয়াগুণে অন্তরে ভেদভাব (গুণের মিলন) দান করিতেছ। অর্থাৎ তুমি আছ সর্ব্বময় তাহা প্রদর্শীত করিতেছ‌।



১৬)       প্রণিপাত শ্রীচরণে করি বার বার,
             নমি প্রভু তব পদে দেবেশ আবার।
            যে তুমি অভেদভাব কর বিতরণ,
            ভেদ ভাবময় এই ভুবনে এখন।।

       তোমার ঐ সুন্দর চরণে বার বার প্রণাম করিতেছি, হে দেবেশ্বর তোমার চরণে পড়ে আছি। তুমি যে অভেদভাব  (সর্ব্বময় যেমন অন্তরে ও বাহিরে) প্রদান করতেছ তাহা এই পৃথিবীতে ভেদ ভাবময় ( গুণ মিলন) অবস্থা তুমি আছ সর্ব্বময় তাহা দেখিতে পাইতেছি। (যাহাই দেখি তাহাতেই তোমার রূপ প্রদর্শিত হয়।)


১৭)     প্রণিপাত শ্রীচরণে করি বার বার,
          নমি প্রভু তব পদে দেবেশ আবার।
          এখন অভেদ তুমি সহিত আমার,
         সকলের সনে আমি পূজনে তোমার।।

       তোমার ঐ সুন্দর চরণে বার বার প্রণাম করিতেছি, হে দেবেশ্বর তোমার চরণে পড়ে আছি। তুমি এখন অভেদ হয়ে ( মিলেমিশে) আছ আমার সঙ্গে, অতএব তোমার গুণকীর্ত্তন করি সকলের সন্মুখে।


১৮)      তব অনুগ্রহে দেব মম পাপচয়,
           বিদূরিত বিনাশিত হয়েছে নিশ্চয়।
           জন্মেছে নির্ন্মলভাব হৃদয়ে আমার,
        কেবল করুনাসিন্ধু ! পূজনে তোমার।। 

       হে দেবেশ্বর তোমার সদাগ্রহে আমার সর্ব্ব পাপ-তাপ দূরে গিয়া নিশ্চয় ধ্বংস হইয়াছে। আমার হৃদয়ে নির্মলভাব (প্রশান্তি ভাব) জমা হয়েছে। কেবল তোমার করুণা গুণে তাহা সিদ্ধ হইল এবং তোমার গুণকীর্ত্তনের জন্যই, উহার পূর্ণ প্রাপ্তি হইল।


১৯)       প্রণিপাত শ্রীচরণে করি বার বার,
             নমি প্রভু তব পদে দেবেশ আবার।
             বিশ্বস্থিতি হয় দেব তব অবস্থানে,
           আর তব পূজাগুণে দাস বিদ্যমানে।।

       তোমার ঐ সুন্দর চরণে বার বার প্রণাম করিতেছি, হে দেবেশ্বর তোমার চরণে পড়ে আছি। হে গুণময় গুরুদেব, তুমি যেখানে থাক, যদি চাহ তোমার ইচ্ছায় এ বিশ্ব দাঁড়াইয়া যায়, আবার তোমার গুণকীর্ত্তন কালে এই ভৃত্যের-ও ঐ অবস্থায় পরিণত হয়। (গুরু ভাবময় অবস্থায় রহিলে উহা হইতে পারে।)


২০)       নমস্কার তবপদে করি বার বার,
             নির্ব্বিকার হয়ে দেখাইছ সবিকার।
           মোহন কারনে আর নিস্কাম আত্মায়,
           মহাকামিরূপে;দেব ! নমি তব পায়।।

      তোমার ঐ চরণে বার বার নমস্কার করিতেছি, তুমি বিকার শূন্য হইয়াও সকলেরে দেখাইতেছ শুদ্ধ বিকারবস্থা। তোমার গুণকর্ষনের কারণে নিস্পৃহ আত্মায়ও তুমি মোহিত করিয়া থাক, হে গুরুদেব তোমার এই অপূর্ব্ব  মহাকামিরূপের; কারণে (মহাকর্ষিত রূপ) নত হই ঐ চরণে।

      
২১)    নমস্কার তবপদে করি বার বার
       নমি প্রভু তব পদে দেবেশ আবার।
       অনির্ব্বাচ্য অনির্দ্ধার্য্য ! চরণে তোমার
       প্রণত দেবেশ, আমি হই বার বার।।

    তোমার ঐ সুন্দর চরণে বার বার প্রণাম করিতেছি, হে দেবেশ্বর তোমার চরণে পড়ে আছি। বাক্যে যাহা প্রকাশ করা যায় না (বাক্যাতীতাবস্থা ) ! এ অপরূপ অবস্থা যাহা অর্ণিরূপিত ভাব (রূপাতীতবস্থা )! আমি বার বার নত হইয়া প্রণাম করিতেছি হে দেবের দেব।


২২)     এই গুরুগীতা হয় গুরুভাবময়,
         ভক্তি মুক্তি দান করে জানিবে নিশ্চয়।
          মুমুক্ষু একাগ্র হয়ে যদি পাঠ করে,
          গুরুলোকে মম সহ রহে সেই পরে।।

      এই গুরুগীতা গুরু ভাবময় হইয়া পাঠ করিলে  ভক্তি সহযোগে নিশ্চয় মক্তি হয় ইহা জানিও। মুক্তি লাভেচ্ছু ব্যক্তি একাগ্র হইয়া যদি পাঠ করে তাহা হইলে গুরুলোকে অর্থাৎ ঈশ্বরলোকে, সেই স্থানে 'আমার' সহিত থাকিতে পারিবে।

                গুরুগীতা ধ্যান সমাপ্ত।


    গুরুদেবের ধ্যান শুধু গুরুদেবের মূর্ত্তি চিন্তা করিলেই হইবে না তাঁহার গুণের কথা চিন্তা করিতে হইবে, উহাই "গুরুগীতা" গুরুদেব ঐ ভাবেই অভেদ হইয়া আছেন পরমপিতার সহিত। উঁহাই চিন্তা করিতে করিতে পরম প্রাপ্তি ঘটিয়া থাকে অর্থাৎ ঈশ্বর ধ্যানে নিমগ্ন হওয়া যায়। পরবর্তীতে" গুরুভক্তির পূর্ব্বাবস্থায়" "ঈশ্বর ভক্তির পূর্বাবস্থায়" ঈশ্বরসঙ্গীতে প্রদর্শিত হইয়াছে।

        ব্যাখ্যা- আদিষ্ট নিরুপম।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ