গুরুভক্তি সঙ্কট।
গুরুদেব গুরুতত্ত্বে লিখিয়াছেন, "গুরুভক্তিই যে ঈশ্বরভক্তির পূর্ব্বাবস্থা সুতরাং গুরুর প্রতি প্রগাঢ় ভক্তি করা, শিষ্য মাত্রেরই কর্ত্তব্য।
ভক্তি প্রবন্ধে বলিয়াছেন যে, "মঙ্গলময়ের মঙ্গলরাজ্যে যাবতীয় মিশ্রগুণের মধ্যে ভক্তি অতি উৎকৃষ্ট গুণ। প্রেমের হীনতাকে বা প্রেমের সীমাবদ্ধ ভাবকে ভক্তি কহে। যে গুণ দ্বারা উপকারী বা আপন অপেক্ষা উন্নত মহাত্মার প্রতি কৃতজ্ঞতা সহকারে মন আকৃষ্ট হয়; যে গুণ দ্বারা সুখে সুখ, দুঃখে দুঃখ ইত্যাদি ভাবসকল "ইনি আমা অপেক্ষা উন্নত" এই জ্ঞান সহকারে সীমাবদ্ধ ভাব উপস্থিত হয়, যে গুণে ঐ
গুণের ভাজনের দুঃখ নিবৃত্তি ও সুখ বৃদ্ধি করা জীবনের মহাব্রত বলিয়া প্রতীয়মান হয়, ফলতঃ যে গুণ দ্বারা প্রেম প্রবন্ধে প্রেমের যে সকল লক্ষণ নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে, তৎসমুদয়ের অধিকাংশ অপেক্ষাকৃত অল্পতর ভাবে উপস্থিত হয়, তাহাকে ভক্তি কহে। অথবা নিজের স্বার্থের জন্য নির্ভরতা বা র্নিভরতার অঙ্কুর হৃদয়ে উদিত হইয়া অন্যের প্রতি যে আসক্তি বা অনুরাগ উৎপাদন করে তাহাকে ভক্তি কহে। মূলকথা ভয়ে ভয়ে ভালোবাসাকে ভক্তি কহে।"
ভক্তিতেই সাধকের মুক্তি, তাঁহা বিনা উন্নতির উপায় নাই। সাধক যে গুণে একত্ব পাইতে যাইতেছে, সেই গুণের প্রতি যে ভক্তিধ্যান, তাহাকে সাত ভাগে ভাগ করিতে পারি যেমন, প্রথম ভক্তিসুপ্ত অর্থাৎ বহু গুণের আপ্যায়নের অবস্থা, দ্বিতীয় ভক্তির অঙ্কুর, তৃতীয় ভক্তির প্রকাশ, চতুর্থ ভক্তি রস, পঞ্চম ভক্তি রসময় অবস্থা অর্থাৎ ভক্তি বিগলিত ময়, ষষ্ঠ ভক্তি রসময়ান্তঃকরণ অর্থাৎ ভক্তি রসে প্লাবিত হওয়া এবং তৎপরে ঐ গুণে ভক্তির পরাকাষ্ঠা প্রাপ্তি ঘটে।
পরমপিতার প্রতি ভক্তি অসীম, কেননা অনন্ত ভাবে একত্ব প্রাপ্ত হইলেও তাঁহাকে পূর্ণ ভাবে পাওয়া সম্ভব না, সুতরাং একটি একত্ব পরমপিতার প্রতি ভক্তির কিঞ্চিৎ মাত্র প্রাপ্তি । গুরু যে গুণে একত্ব পাইয়াছে, শিষ্য সেই গুণে একত্ব পাইতে পারে। আর যে মহাত্মা ক্রমশ একত্ব পাইয়া যাইতেছেন, তাঁহার প্রতি কিদৃশ ভক্তি সম্পন্ন হওয়া প্রয়োজন একবারটি ভাবুন। গুরুদেব বলিয়াছেন "সমদর্শন" সাধনা গুরুভক্তির নামান্তর । তাহা হইলে যে ব্যক্তি সমদর্শন সাধনায় সিদ্ধ হইয়াছেন, সেই ব্যক্তিরই গুরুর প্রতি গুরুভক্তির শুভ সূচনা হইল। তাহার পূর্ণতা লাভ ( ভক্তি প্রেমে পরিণত)
করিবে যখন সে একত্ব লাভ করিবেন অর্থাৎ গুরুর সহীত তাহার ঐ গুণে একীভবন হইবে। এইভাবে বহু গুণ পশ্চাতে দাঁড়াইয়া আছে, সেই গুণে একত্ব পাইতে গেলে গুরুর প্রয়োজন বিনা অসম্ভব। শিষ্যের কাছে গুরুর যে ঋণ থাকিয়া যায়, তাহা একপ্রকার মুক্ত হইতে পারে, যদি সে একত্ব প্রাপ্ত হইতে পারে। শিষ্যের ইহাই কর্ত্তব্য। কেননা গুরুদেব বলিয়াছেন, যে অধিক উপাসনা করে সেই আমার প্রিয়" অর্থাৎ পরমপিতার নিকটে গুরুদেব যে অঙ্গীকার করিয়াছিলেন, তোমার কাছে এই সন্তানকে পৌঁছে দেবো। একপ্রকার পরমপিতার নিকটে গুরুদেব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করিলেন । তাঁহার কর্ত্তব্য তিনি করিয়া যাইতেছেন। এখন আমাদের কর্ত্তব্য কি ?
আমরা দেখিতে পাইতেছি যে গুরু " ব্রহ্মদর্শী, সর্ব্ব-পাশ- বিমুক্ত, সুতরাং তদীয় কার্য্যে দোষলেশাশঙ্কা অনুচিত।" যেমন " জগতের সৎপুরুষেরা স্বার্থ পরিত্যাগ করিয়া পরার্থ ঘটনা করিয়া থাকেন। এক্ষনে বিবেচনা করিয়া দেখ, যিনি স্বার্থ পরিত্যাগ- পূর্ব্বক তোমাদিগের হিতব্রতে ব্রতী হইয়াছেন, যিনি স্বীয় অমূল্য সময় তোমাদিগের জন্য ব্যয়িত করিতেছেন, যিনি তোমাদিগের দুঃখ- দারিদ্র্য নিবারনণার্থে স্বয়ং দুঃখ দারিদ্র্য ভোগ করিতেছেন, যিনি তোমাদিগের পাপতাপ-হরণার্থে বহু সময়ে সন্তাপ
ভোগ করিয়া থাকেন, এবং যিনি তোমাদিগের নিকট কিছুই চাহেন না, কেবল তোমাদিগের উন্নতি, আরোগ্য, সৌভাগ্য দর্শন করিয়াই পরম সন্তোষলাভ করেন সেই স্বার্থলেশবিবর্জিতা, নিস্পৃহ, শান্তচিত্ত, ব্রহ্মদর্শী মহাপুরুষ যে মানবমাত্রেরই ভক্তিভাজন।"- গুরুতত্ত্ব । এইরূপ মহঃউন্নত মহাপুরুষকে নিজের উন্নতির জন্য গুরু বলিয়া স্বীকার করিয়া পরিশেষে তাহাকে ত্যাগ করিলে কি হইতে পারে একবারটি ভাবুন? তাহাকে কটু বাক্য ব্যবহার করিলে কি হইতে পারে ? তাঁহার প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করা হইলে কি হইতে পারে? এবং বিশ্বাস না করিয়া দোষানুশীলন করিলে কি হইতে পারে একবারটি ভাবিবেন না?
"যদিচ দীক্ষাদাতা গুরু বা অন্যান্য মহাত্মাদিগের প্রতি প্রথমাবধিই প্রেম করিতে পারিলে বড়ই সুখের বিষয় হয় বটে, কিন্তু যাঁহারা আমাদিগের নৈসর্গিক ভক্তিভাজন, সেই মাতা ও পিতার প্রতি অগ্রে ভক্তি না করিয়া বা পার্থিবভক্তি পূর্ণ না করিয়া যদি কেহ তাঁহাদিগের প্রতি প্রেম করিতে প্রবৃত্ত হয়, তবেই সে ভক্তিসঙ্কটে পতিত হইল। এতাদৃশ বিপন্ন ব্যক্তির উদ্ধার এজন্মে আর হইবার সম্ভাবনা নাই । জন্মান্তর অন্য কোন রমণীর প্রতি ( যাহার গর্ভে জন্মিবে তাহার প্রতি) ভক্তি সাধনা করিয়া, ঐ ভক্তি পূর্ণ করিতে হয় । পরে, পূর্ব্ব জন্মের মাতাপিতার প্রতি ভক্তিসাধনা করিয়া, ঐ বিপদ হইতে মুক্ত হইতে পারে।"
"অপর, কেহ কেহ মাতাপিতার প্রতি ভক্তি না করিয়া, প্রথমেই অন্য কাহারও প্রতি ভক্তি করে। ইহারাও ভক্তি-সঙ্কটে পতিত, সন্দেহ নাই। কারণ, মাতাপিতার প্রতি ভক্তি না করিলে, অনন্ত ন্যায়বান মঙ্গলময় পরমপিতার নিয়মানুসারে যাবৎ ঐ মাতাপিতার উদ্ধার না হইবে, তাবৎ তাহার ও উদ্ধার নাই। যদি কোন আত্মা অতি উচ্চ স্থান হইতে আসিয়াও পুনরায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁহাকেও এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইতে হয় ।"
ইহার তাৎপর্য্য এই যে নৈসর্গিক ভক্তিভাজনের ক্ষেত্রেই যদি এমত দূর্ব্বিসহ পরিস্থিতি হয়, তাহা হইলে যিনি স্বার্থ পরিত্যাগ- পূর্ব্বক তোমাদিগের হিতব্রতে ব্রতী হইয়াছেন এবং যিনি অমুল্য রত্ন প্রদান করিলেন, যে ধনের কাছে নিখিল বিশ্ব অতি নগণ্য, সেই বীজমন্ত্র প্রেরকের প্রতি ভক্তিসঙ্কট হইলে কি দৃষ পাপ হইতে পারে তাহা গুরুদেব অন্তরালে বলিয়া গিয়াছেন ।
নৈসর্গিক নিয়মে আমাদের মাতা-পিতার প্রতি ভক্তি না করিলে, যাবৎ ঐ মাতাপিতার উদ্ধার না হইবে, তাবৎ তাহারও উদ্ধার হইতে পারে না। সেইরূপ পরমপিতার রাজ্যে প্রবেশ করাইবার জন্য যে কঠোর ক্লেশ আমরা গুরুকে দিয়া থাকি, তাহাকি অনুভব করি? নিশ্চয়ই না। পূর্ব্ব জন্মজন্মার্জিত এবং ইহজন্মকৃত সমস্ত পাপ-তাপ তিনি গ্রহণ করেন, তাহাতে তাহার কিরূপ যন্ত্রণা হয় তাহা গুরুদেব নানান জায়গায় প্রকাশ করিয়াছেন। দীক্ষা কালে পাপ গ্রহণ
(দীক্ষা কালে গুরু যখন শিষ্যের পাপ গ্রহণ করেন, তখন ঐ মূহুর্তের এবং জন্মজন্মার্জিত ও ইহ জন্মকৃত পাপের প্রথম আচ্ছাদন ছেদন করেন। পরে পূর্ণ ভাবে সাধনা দ্বারা প্রতিদিন কৃত ও জন্মজন্মার্জিত এবং ইহ জন্মকৃত পাপ হইতে মুক্ত হইয়া ঈশ্বর রাজ্যে গমন করিতে হয় শিষ্যকে।)
(দীক্ষা কালে গুরু যখন শিষ্যের পাপ গ্রহণ করেন, তখন ঐ মূহুর্তের এবং জন্মজন্মার্জিত ও ইহ জন্মকৃত পাপের প্রথম আচ্ছাদন ছেদন করেন। পরে পূর্ণ ভাবে সাধনা দ্বারা প্রতিদিন কৃত ও জন্মজন্মার্জিত এবং ইহ জন্মকৃত পাপ হইতে মুক্ত হইয়া ঈশ্বর রাজ্যে গমন করিতে হয় শিষ্যকে।)
করিবার পর তৎক্ষণাৎ কর্ত্তন করিয়া ফেলেন ঠিকই, কিন্তু নিজেকে শিষ্যের পাপ স্পর্শ করাইতেই হয়, কেননা পাপের মাত্রার অনুপাতেই চক্রের গুণাগুণ নির্ণয় করিয়াই বীজ নির্ধারণ করিতে হয়। ঐ সামান্য পাপের স্পর্শে তাঁহাকে বহু ক্লেশ পাইতে হয়, তাহা প্রকৃত গুরু ছাড়া কেহই অনুভব করিতে পারে না। ইহা সকল সৎসতীর মনে-প্রাণে বাঁধিয়া রাখা উচিত। উহার পর গুরুর কর্ম্ম আরও বাড়িয়া যায়, কেননা গুরু শিষ্যের পাপের ভাগী হন কিন্তু শিষ্য পুণ্য করিলে উহার ভাগী গুরু হন না। কেননা যখন হইতে গুরু তাহার জন্মজন্মার্জিত পাপ গ্রহন করিলেন, তখনই
তিনি শিষ্যের সমস্ত ভার গ্রহন করিলেন। প্রকারান্তরে তিনি শিষ্যের ঈশ্বর দর্শনের সঙ্কল্পও করিলেন। ইহাতো গেল গুরুর কর্ত্তব্যের কথা । পরমপিতা স্বাধীনতা দিয়েছেন, তাহাতে তিনি হস্তক্ষেপ করেন না, তাই গুরুদেবও তা করেন না। এমনকি কন্টকময় অবস্থায় চলিতে হয় তাঁহাকে, তাই তিনি বারবার শিষ্যকে শুধু উপদেশটুকু দিতে পারেন। তাহাতেই তাহার যাহা কাজ হয় সেইটুকুই তাঁহার প্রাপ্য, কেননা গুরু যদি শিষ্যকে অধিক প্রভাব ( অর্থাৎ স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ) খাটাইতে যায় তাহা হইলেও গুরুরও পাপ হইয়া যায়। তাহা হইলে ভাবুন, গুরুর যন্ত্রণার কথা। এখন শিষ্যের কি করিবার প্রয়োজন? গুরুকে বারংবার যন্ত্রণা দেওয়া,
নাকি গুরুর কথামতো পথে চলা??? দীক্ষারূপ পরম জন্মের মাধ্যমে যেমনটি আমাদের তিনি গ্রহণ করেন, সেই গুরুদেবের প্রতি যদি কোনও শিষ্যের ভক্তিসঙ্কট হইয়া যায়, তাহা হইলে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করিতে হয়, তাহা ভাষায় ব্যাক্ত করা অসাধ্য। কিন্তু গুরু তবুও তাহাকে পরিত্যাগ করেন না, শিষ্যের প্রতি গুরুর কর্ত্তব্য রহিয়া যায়। ইহারই সুবাদে উপদেশ দিয়া যাইতে হয় । আবার শিষ্যের ইচ্ছার বিরুদ্ধে উপদেশ দিলেও গুরুর পাপ হইয়া যায়। এই কারণে শিষ্যের আগ্রহের বশে গুরুকে উপদেশ দিতে হয়।
শিষ্যের ভক্তিসঙ্কট হইলে কিদৃশ যন্ত্রণা উপস্থিত হয় তাহা গুরুদেব গুরুগীতায় প্রকাশ করিয়া গিয়াছেন। "প্রসন্ন হইলে তুমি, প্রসন্ন ভূবন, সুরাসুর সবে হেরি প্রসন্ন তখন । কুপিত হইলে তুমি ক্রোধময় সব, প্রণিপাত করি তোমা, অচিন্ত্য-বিভব।।" অর্থাৎ গুরুদেব অধমর্ণ অভেদ করিয়া আছেন তাই সমস্ত পৃথিবীর যেসব পদার্থ দেখিতে পাই, যেমন পাহাড়- পবর্ব্বত, নদী-নালা, বৃক্ষ-লতা, জড়-চেতন, বায়ু-তাপ,
পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ মানব-মানবী ও সুরাসুর অর্থাৎ ভাল-খারাপ ইত্যাদি সকলেই প্রসন্ন অর্থাৎ শান্ত থাকে আর তুমি যদি আমার প্রতি প্রসন্ন না হও তাহা হইলে উহারাও রাগ অর্থাৎ কুপিত হইয়া যায়। আর যাহাদের চিন্তায়ও আনিতে পারি না তাহারাও আমার প্রতি রাগ করিয়া বসে, ক্ষমা করো গুরুদেব, তোমাকে নমস্কার করি। সর্ব্ব প্রথমে "সহজজ্ঞান" অর্থাৎ তাঁহাকে সন্দেহহীন হইয়া সহজ ভাবে মানিয়া লওয়া এবং দ্বিতীয় কর্ত্তব্য "নির্ভরতা" অর্থাৎ সম্পূর্ণ ভাবে নিজেকে গুরুর কাছে এ জীবনের ভার অর্পণ করা, পরিশেষে তৃতীয় কর্ত্তব্য "বিশ্বাস" অর্থাৎ যাঁহাকে আমি আমাকে
সমর্পণ করিলাম, মনে করিয়া লইতে হয় তিনিই সব, আমি কেহ না। তাহা হইলেই কিছু দিনের মধ্যে দেখিতে পাইবে যে তাহার উন্নতি হইতেছে। এই তিনটি গুণ বিনষ্টের কারণেই দূর্ব্বিসহ গুরুভক্তি বিনাশের দিকে অগ্রসর হইতে থাকে । যে তেরোটির অধিক গুণ বিশিষ্ট হইলে সত্যধর্ম্ম লাভ করা যায়, তাহাকে সংক্ষিপ্ত করণ করিয়া অমূল্য রত্ন স্বরূপ সাধারণের জন্য তিনটি গুণে সত্যধর্ম্ম লাভের পথ হইয়াছে। তাঁহাকে প্রতি মুহুর্তে রক্ষা করা শিষ্যের প্রধান কর্ত্তব্য।
গুরুভক্তি সঙ্কট হইলে কি হইতে পারে।
গুরুদেব সর্ব্বক্ষণ ক্ষমা করিয়া থাকেন, কেননা শিষ্যের আধ্যাত্মিক জীবনের ভার তিনি নিয়াছেন । তাই শিষ্য যদি কোনও রূপ ভক্তির ব্যাঘাত জনিত কোন কাজ করিয়া থাকে তাহা হইলে, পারলৌকিক মহাত্মাদের কোপ অর্থাৎ কালোগ্রাসে পতীত হইতে হয় । " সাধারণতঃ ব্যভিচার ও অন্যতরের পরিত্যাগ প্রভৃতি কারণে প্রেম ভঙ্গ হয়। প্রেমভঙ্গ অর্থাৎ প্রেমাস্পদের ঐরূপ অভাব হইলে আত্মার ঘোর কষ্ট উপস্থিত হয় ও উন্নতির পথে অগ্রসর হওয়া বড়ই সুকঠিন হইয়া পড়ে। আর এইটী প্রকৃত প্রেম হইবার পর হইলে অর্থাৎ প্রকৃত প্রেম ভঙ্গ হইলে,
আত্মার অশেষ ক্লেশ হয়, আত্মপ্রসাদ বিলুপ্ত হয়, যাতনার সীমা থাকে না। প্রকৃত প্রেমভঙ্গ হইলে হৃদয়ে যে দঃসহ ক্লেশ উপস্থিত হয়, তাহা ইহলোক ও পরোলোকে থাকে এবং পারলৌকিক উন্নতির পক্ষে ও অনেক বাঁধা প্রদান করে। এ ক্লেশের শান্তি সাধারণতঃ ইহলোকে হয় না, পরলোকে ও বহু যাবত পর্যন্ত ঐ ক্লেশ যায় না। সংসারে যত কিছু পাপ আছে, প্রকৃত প্রেম ভঙ্গ হইতে অধিক কিছু নাই ঐ পাপ মাতৃহত্যার দশগুণ বা তদপেক্ষা অধিক।" -প্রেম প্রবন্ধ। এবং প্রতি মূহুর্তে নিন্মমুখী ধাবিত হইতে থাকে, বিশেষ করিয়া স্বার্থপরতা ভীষণ ভাবে গ্রাস করিতে থাকে ।
মস্তিষ্কে ভীষণ চাপ সৃষ্টি হয়, হিতাহিত জ্ঞান থাকে না, জীবন বিষময় হইয়া পড়ে এবং অধিকাংশ সৎগুণ বিনষ্ট হইয়া যায়। ইহা প্রথম প্রথম অনুভব হইলেও, পরে বহুদিন অতিবাহিত হইবার কারণে উহাও বুঝিতে পারে না। গুরু কিন্তু প্রতি মুহুর্তে শিষ্যকে সমাধান করেন, কিন্তু না শুনিলে তিনি নির্ব্বিকার থাকেন। ইহজন্মে যদি ঠিক না হয়, পরবর্তী জন্মে তাহাকে উহার জন্য কি দূর্গতি হইয়া ছিল তাহা স্মরণ করাইবার প্রয়াস করিয়া থাকেন ।
গুরুভক্তিসঙ্কট যাহাতে না হয়। তাহার জন্য কি কি করা উচিৎ।
১/ "গুরু যাহা যখন আদেশ করিবেন, তখনই তাহা করিবে। তাহাতে দোষ গুণ বিচার করিওনা। এ জগতে যাহাকে লোকে অতি পবিত্র কার্য্য ভাবে, গুরু যদি তাহাও নিষেধ করেন, তবে তাহাও করিবে না। আর লোকে যাহাকে ঘোর পাপ বলে, গুরু যদি তাহাও করিতে বলেন, তাহাও অম্লান বদনে প্রফুল্ল মুখে করিবে। ভক্ত শিষ্যের নিকটে গুরুর আদেশ পালনই পুণ্য এবং গুরুর আদেশ লঙ্ঘনই-পাপ। ইহা ভিন্ন আর পাপ পুণ্য নাই ।"
২/ "কোনও বিষয় অনুমান দ্বারা বুঝিয়া লইও না। ধর্ম্ম বিষয়ের আদেশ মিলিটারী ডিপার্টমেন্টের আদেশের ন্যায়-নিবৃত্তির আদেশের পূর্ব্ব পর্য্যন্ত চালাইয়া যাইতে হয় ।"
৩/ "যাহার কৃপায় তুমি সৎপথ- জগদীশ্বর লাভের পথ প্রাপ্ত হইয়াছ, সেই গুরুদেবের প্রতি প্রগাঢ় ভক্তি করিবে" ।
৪/ "মনে মনে সমস্তই গুরুকে নিবেদন করিয়া দিবে এবং "তাহার প্রসাদ ভোগ করিতেছি"- এই জ্ঞানে সকল কার্য্য করিবে।"
৫/ " জ্ঞানপূর্ব্বক ভক্তিভাজনের অভিমত কার্য্য সম্পাদক না করিলে, ভক্তির হ্রাস হয়।" -ভক্তি প্রবন্ধ ।
৬/ "ভক্তিভাজনে অবিশ্বাস দ্বারা ভক্তির হ্রাস হয়। কারণ যাহাকে বিশ্বাস বা প্রত্যয় না করা যায়, তাহার প্রতি স্নেহ ব্যতীত অন্য কোন সদ্ভাব হইবার সম্ভাবনা নাই ।" -ভক্তি প্রবন্ধ।
৭/ "নিরন্তর ভক্তিভাজনের দোষানুশীলন- যাঁহার প্রতি ভক্তি করিতে হইবে, প্রথমাবধি যদি তাঁহার কেবল দোষই চিন্তা করা যায়, তাহা হইলে ভক্তি উৎপন্ন হইতে পারে না।" -ভক্তি প্রবন্ধ।
৮/ "ভক্তিভাজনের স্নেহে বঞ্চিত হওয়া - দূর্ভাগ্যক্রমে যদি ভক্তিভাজন স্নেহে বঞ্চিত হওয়া- দূর্ভাগ্যক্রমে যদি ভক্তিভাজন স্নেহ না করেন, তাহা হইলেও ভক্তির হ্রাস হইবার সম্ভাবনা। স্নেহ-বারি-সেক লাভব্যতীত ভক্তিলতার উৎপত্তি ও বৃদ্ধি বড়ই সুকঠিন।" -ভক্তি প্রবন্ধ ।
৯/ "কৃতজ্ঞতা লঘুতর হইলেও ভক্তির হ্রাস ও হয়।" -ভক্তি প্রবন্ধ ।
১০/ "এতদ্ভিন্ন করুণরস, মমতা প্রভৃতির হীনতায়ও ভক্তির হ্রাস হইয়া থাকে। মূলকথা, হৃদয়ের উন্নতি অনুসারে, যেমন ভক্তি বৃদ্ধি হয়, তদ্রূপ হৃদয়ের অবনতি-অনুসারে, ভক্তির হ্রাসও হয় ।" -ভক্তি প্রবন্ধ ।
মূলকথা সহজজ্ঞান, নির্ভরতা ও বিশ্বাস ইহা যাহাতে বিনষ্ট না হয় এবং রীতিমত উপাসনা করিলে এই ভক্তি সঙ্কট হইতে নিস্তার পাওয়া সম্ভব।
"যদি মুক্তিলাভ করিতে ইচ্ছা কর, যদি ভগবন্নামামৃত পানে সংসার বিষজ্বালা হইতে বিমুক্ত হইতে অভিলাষ কর, যদি পরমেশ্বরের প্রেমসুধা পানে অভিলাষী হও এবং যদি মানবজীবনের সফলতা লাভ করিবার ও ব্রহ্মদর্শনজনিত পরমানন্দ প্রাপ্ত হইবার সঙ্কল্প করিয়া থাক, তবে জগদীশ্বরের প্রতি ভক্তি ও প্রেম কর এবং ঐ গুণদ্বয় ও অন্যান্য মহানগুণ লাভ করিবার জন্য এবং সাধনা মার্গে সুচারুরূপে পরিচালিত হইবার নিমিত্ত ব্রহ্মদর্শী মহাত্মাকে গুরুরূপে পরিচালিত হইবার নিমিত্ত ব্রহ্মদর্শী মহাত্মাকে গুরুরূপে বরণ করিয়া জীবন সফল কর এবং অভীষ্টলাভে কৃতার্থ হও ।"
-আদিষ্ট নিরুপম।
0 মন্তব্যসমূহ