করুণরস ও মমতার হীনতায় ভক্তি হ্রাস হয়।
করুণরস দ্বারা প্রেমের উৎপত্তি ও বৃদ্ধি হয়। করুণরস থাকিলে অপরের সুখে সুখ, দুঃখে দুঃখ বোধ হয়। এই গুণটী যাবতীয় চেতন পদার্থেই বিদ্যমান আছে বটে, কিন্তু সকল হৃদয়ে সমান পরিমাণে নাই। সুতরাং প্রেমার্থীর পক্ষে ইহার বৃদ্ধি করা নিতান্ত আবশ্যক। করুণরসের বৃদ্ধি করিতে হইলে, প্রথমে অপচিকীর্ষা ও অসূয়াবৃত্তির দমন করা নিতান্ত কর্ত্তব্য। অপচিকীর্ষা অর্থাৎ অন্যের অপকার করিবার ইচ্ছা। এই বৃত্তি দমন করিতে হইলে অন্যের অস্কারে নিবৃত্ত এবং যথাসাধ্য পরোপকারে প্রবৃত্ত হইতে হয়। তদ্ভিন্ন "আমি কার্য্য করিতে পারি, কিন্তু কার্যলয়ের প্রদান আমার আয়ত্ত্ব নহে, অর্থাৎ আমি অপরের অপকার বা উপকার করিবার চেষ্টা বা চিন্তা করিতে পারি বটে, কিন্তু ঐরূপ করিলেই যে, তাহার অনিষ্ট বা ইষ্ট হইবে, এরূপ নহে; কারণ সে যেরূপ উপযুক্ত, তদনুসারে পরম ন্যায়বান ঈশ্বর তাহাকে ফলপ্রদান করিবেন। তবে আমার চেষ্টা ও চিন্তার ফল এই মাত্র হইবে যে, তাহাতে আমি যথাক্রমে পাপস্পৃষ্ট ও পুণ্যপ্রাপ্ত হইবে।" ইত্যাদিরূপ জ্ঞানলাভ করিতে হয়। আর, অসূয়া অর্থাৎ গুণীব্যক্তির গুণে দোষারোপ করা। এইটী নিবারণের উপায় এই যে, প্রথমে কার্য্যে অন্যের দোষারোপ করিতে নিবৃত্ত হইলেই পরিশেষে ঐ দোষ হৃদয়ে হইতেও দৃরীভূত হইয়া যায়।
এই দুইটী বিপরীত কারণের অর্থাৎ বৃদ্ধির প্রতিকূল সেতুর নিবারণ করা যেরূপ আবশ্যক, আরও কতকগুলি অনুকূল কারণের প্রবর্তনও তদ্রূপ প্রয়োজনীয়। যথা- করুণরসাত্মক গ্রন্থপাঠ, করুণরসোদ্দীপক ব্যাপার ঘটিলে তথায় উপস্থিত হওয়া, দুঃখার্ত্তকে সান্ত্বনা করা এবং উপচিকীর্ষা অর্থাৎ অন্যের উপকার করিবার ইচ্ছা, ইত্যাদি।
এই করুণরস সহজও বটে, কঠিনও বটে। সহজ এই অংশে যে, ইহা জীবমাত্রেরই স্বাভাবিক ধর্ম্ম, এবং কঠিন এই যে, সংসার যেরূপ জটিলতাময়, তাহাতে পদে পদে এই গুণের ব্যাঘাত ঘটে, সুতরাং সবিশেষ সাধনা ব্যতীত এই ব্যাঘাতময় সংসারে ইহাকে অক্ষুণ্ন রাখা ও বর্দ্ধিত করা বড়ই কঠিন।
মমতা -- "এই বস্তুটি আমার" এইরূপ জ্ঞানকে মমতার অঙ্কুর কহে। মমতা সরল গুণ, ইহার দ্বারা প্রেমের বৃদ্ধি হয় বটে, কিন্তু প্রেমের বর্দ্ধিতাবস্থায় (অভেদ জ্ঞান সময়ে) যাঁহার সহিত অভেদ জ্ঞান হয়, তাহার সম্বন্ধে উহার সম্পূর্ণ লোপ হইয়া থাকে। তখন "এ আমার" এইরূপ জ্ঞান তিরোহিত হইয়া, "এ আমি" এইরূপ জ্ঞান হয়। এজন্যই মহাত্মারা কেহ কেড়ে বলিয়াছেন যে, মমতা দ্বারা প্রেমের বৃদ্ধি হয় এবং অপর কেহ বলিয়াছেন যে, প্রেমাবস্থায় অভেদ পাত্রের প্রতি মমতা থাকে না।
আমরা তাহাদিগের সহিত নৈসর্গিক নিয়মে মমতায় বদ্ধ (যথা পিতা, মাতা, পুত্র, কন্যা প্রভৃতি) অগ্রে তাহাদিগের প্রতি সদ্ভাব সঞ্চারিত হয়। এই নিমিত্তই প্রেমবৃত্তের প্রকৃত কেন্দ্র আপন গৃহ। উহা ঐ স্থান হইতে উৎপন্ন ও বর্দ্ধিত হইয়া, পরিশেষে সার্ব্বভৌমভাবে নিখিল ব্রহ্মাণ্ডে বিস্তীর্ণ হইতে থাকে।
--বিশ্বময়ী দেবী।
--বিশ্বময়ী দেবী।
