যথোচিত ভক্তি।



   যথোচিত ভক্তি করা মানব মাত্রই কর্ত্তব্য।
   
                                   মাতা

   যে পরমারাধ্যা জননী সন্তানকে গর্ভে ধারণ করিয়া অশেষ ক্লেশরাশি ভোগ করেন, সন্তানের গর্ভাবস্থান কালে তিনি আহারে, বিহারে, শয়নে, উপবেশনে, সর্ব্বদাই গর্ভস্থ শিশুর মঙ্গলজনক ও অমঙ্গল-নিবারক কার্য্যনিচয়ে সবিশেষ সতর্কতা-সহকারে ব্যাপৃত থাকেন, যিনি গর্ভস্থ অসত্যকে নির্ব্বিঘ্ন রাখিবার জন্য প্রথম কতিপয় মাস অনারান্তে প্রায়শঃ বমনজনিত ঘোরতর ক্লেশ ও ভূমিশয্যায় শয়নজনিত দারুণ দুর্দ্দশা সহ্য করিতেও অনুমাত্র কাতরতা প্রকাশ করেন না; পরন্তু সন্তানের মুখেন্দু দর্শন বাসনায় অনায়াসে পরমানন্দে তৎসমুদায় সহ্য করেন, গর্ভসঞ্চারের পরে কতিপয় মাস অতীত হইলেই যিনি গর্ভস্থ সন্তান হস্তপদ চালনা করে কি না, সে নির্বিঘ্নে নিরাপদে আছে কি না, ইহাই অহর্নিশ চিন্তা করিতে প্রবৃত্ত থাকেন, কিন্তু সন্তান অঙ্গ সঞ্চালন পূর্ব্বক তাঁহার যে ঘোরতর যাতনা উপস্থিত করে, তৎপ্রতি একবারও লক্ষ্য করেন না, বরঞ্চ উল্লিখিতরূপ অঙ্গচালনা অনুভব করিয়া নিরতিশয় আনন্দ-নিরধি-নীরে নিমগ্ন হন, যিনি একমাত্র সন্তানের শুভোদ্দেশে নারীজাতি-সুলভ লজ্জাকেও কিয়ৎকালের জন্য অন্তরিত রাখিয়া পান-ভোজন পরিধানাদী বিষয়ে মনরথ প্রকাশ করিতে সঙ্কুচিতা হন না, যিনি প্রসবান্তে তনয়ের অকলঙ্ক শশাঙ্ক বিনিন্দিত মুখচন্দ্র দর্শন করিয়া প্রসবকালীন অনির্ব্বচনীয় অত্যুৎকট ক্লেশান্ধকার বিদূরিত করিয়া থাকেন, যিনি সন্তানের কল্যাণ সম্পাদনার্থে ঘৃণার প্রধান উৎপাদক মলমূত্রাদি পদার্থেও ঘৃণাশূন্য হইয়া ব্যাখ্যাতীত ক্লেশরাশীকেও অনুমাত্র ক্লেশ বোধ না করিয়া, স্বীয় সর্ব্বসুখ-বিস্মরণ ও অন্য সর্ব্ব চিন্তা পরিত্যাগ পূর্ব্বক অনন্যমনা ও অনন্যকর্ম্মা হইয়া প্রাণপণে তনয়ের লালন পালন করেন, স্তনন্ধয় সন্তান রুগ্ন হইলে তিনি রুগ্নার ন্যায় উপবাস-জনিত কঠোর ক্লেশ ও ঔষধ পত্রাদি সেবন জনিত কষ্টের পরাকাষ্ঠা ভোগ করিয়া থাকেন, সন্তান সুস্থ থাকিলে যিনি তাঁহাকে লইয়া কত আনন্দ, কত আহ্লাদ ও অতি বা আমোদ করিতে প্রবৃত্ত হন, সন্তানগণ যাঁহার শরীর-নিঃসৃত স্তন্যসুধাপানে জীবনের প্রথমাবস্থা--ঘোরতর বিপৎসঙ্কুল আদ্যাবস্থা অতিবাহিত করিয়া থাকে, সন্তানের বাক্যস্ফূর্ত্তিকালে মা মা, বা, বা ইত্যাকার অস্ফুট মধুর-ধ্বনি তদীয় মুখ-নির্গত শ্রবণ করিয়া যিনি অন্ধকারময়ী শীর্ণ পর্ণ-শালায় আসীন হইয়াও আপনাকে, অত্যুজ্জ্বল আলোকমালা পরিশোধিত রমণীয় প্রাসাদবাসিনী অপেক্ষাও সহস্রগুণে সুখিনী বোধ করেন, সন্তানের বাক্যস্ফূর্ত্তি ও গমনাগমনশক্তি সংঘটিত হইলে তিনি অমৃতাধারা তদীয় মুখবিবর হইতে কত বাক্যসুধাই নিঃসারিত করেন, কত রূপই সম্মোহন অঙ্গ ভঙ্গি করিতে বলিয়া থাকেন এবং সন্তান তদনুসারে অঙ্গভঙ্গি-সহকারে নৃত্য করিলে বা নব নব আনন্দজনক বাক্যাবলীর উল্লেখ করিলে তাঁহার প্রত্যেক বাক্যবিন্যাসে ও প্রতি অঙ্গভঙ্গিতে যিনি মধুর-বচন-মনোহর লাবণ্য-ময় নব নব ভূবনে অধিবাস সুখ লাভ করেন, পুত্রকন্যা বিদ্যাভ্যাসে নিযুক্ত হইয়া সুখ্যাতি লাভ করিলে যাঁহার হৃদয়কূপ আনন্দনীরে পরিপূর্ণ হয়, মুখ সুনির্মল প্রফুল্লভাব ধারণ করে এবং নয়ন সুখাশ্রু-বর্ষণ করিতে থাকে। তনয় বিদ্যাভ্যাসকালে দূরদেশে অবস্থান করিলে যিনি স্বীয় মন তাঁহার নিকটে রাখিয়া শূন্যদেহে দৈহিক-কার্য্য নির্ব্বহ করেন, পুত্র সন্নিধানে সমাগত হইলে তিনি পরমানন্দ আনন্দাশ্রু বর্ষণ পূর্ব্বক তদীয় প্রত্যেক অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নিরীক্ষণ করিতে করিতে কতরূপ প্রশ্নই করিতে প্রবৃত্ত হন, তনয় কৃতবিদ্য হইয়া দারপরিগ্রহ পূর্ব্বক বধু-সমভিব্যাহারে আলয়ে আগত হইলে তিনি অপূর্ব্ব অত্যাশ্চর্য্য সন্তানবাৎসল্যবশতঃ পুত্রের অর্দ্ধাঙ্গ-স্বরূপ বন্ধুর প্রতি তনয়ার ন্যায় স্নেহবারি-সেক করিয়া তদীয় ভক্তিলতা পরিবর্দ্ধিত করেন, ফলতঃ যাঁহার স্নেহ ও দয়া অসীম ও অনুপম, যাঁহার বাৎসল্য-জলধি অতলস্পর্শ, যাঁহার সন্তানার্থে আত্মত্যাগ মহীতলে দৃষ্টান্ত শূন্য অপূর্ব্ব ব্যাপার, যাঁহার আর্শীবাদ সন্তানের পক্ষে ঐশ্বরিক বাক্য তুল্য, যিনি সন্তানের মঙ্গলার্থে দুঃখকে সুখ ও মৃত্যুকে জীবন বলিয়া বোধ করেন, সন্তানের মঙ্গল সাধন হইলে যাঁহার নয়নে আনন্দসাগরের উদ্বেলতার পরিচায়ক সুখীতল আনন্দাশ্রু-ধারা বিগলিত ড়য়, এবং অল্পভ সংঘটন হইলে যাঁহার নেত্রে মনস্তাপাধিক্যে বিদীর্ণ হৃদয়ের চিহ্নস্বরূপ অত্যুষ্ণ শোকাশ্রু-প্রবাহিত হয়, সেই পরমারাধ্যা স্নেড়ময়ী বাৎসল্যময়ী জননীর প্রতি-সেই সুবিশাল সাংসারে সর্ব্বপ্রধান ভক্তিভাজন গর্ভধারিণীর প্রতি, সেই অনন্তশক্তিসম্পন্না জগন্মাতার স্থানীয়া মাতার প্রতি, ভক্তি করিলে এবং তদীয় উপাসনায় নিয়ত নিযুক্ত থাকিলে সন্তান যে মুক্তিলাভ করিতে ফিরিবে, তাহাতে আর সন্দেহ নাই। এ বিষয়ে কী যুক্তি, কি শাস্ত্র, সকলেই একবাক্যে যে অনুমোদন করিবে, তদ্বিষয়ে সংশয়াভাব।




   পিতা


কে তবে পালন তরে, করে অনুক্ষণ
      শোণিতে সলিল করি ধন উপার্জ্জন ?
বিদেশে স্বদেশে সম করে বিচরণ
      বিয়োগ রোগের ভয় না করি কখন ?
কে তবে মানস-ভূমি (হেরিং সুসময়),
      কর্ষণে কন্টক নাশি করে শোভাময় ?
তাহে উপদেশ-বীজ করিয়া বপন
     সুফলের আশে কে বা ক্রয়ে যত্ন ?
তাহাতে অঙ্কুর মরি হেরি কোন্ জন
    অনন্দ-নীরধি-নীরে হয় সুমগন ?
তামস-নিস্তার তরে মানস-ভবনে
     কে জ্বালয়ে জান দীপ শৈশব-যৌবনে ?
কাহার প্রসাদের তুমি হেরিলে অবনী,
     যাহাতে অতুল শোভা দিবস-রজনী ?
কোন্ জন রাখে তবে জীবন-তপনে
     তপন-তনয়-রাহু হতে অনুক্ষণে ?
নিখিল পুরুষ হতে ভকতি-ভাজন
    পূজনীয় হয় সদা তবে কোন্ জন ?
জান কি তাঁহারে তুমি চপল-হৃদয়!
     জান কি তাঁহাদের তুমি চপল হৃদয়।
সে জন জনক তব আর কেহ নয়।
     যদি নরাকার পশু নামে কর ভয়,
যদি সুখ-শান্তি-আশা তব মনে রয়,
     যদি প্রতি উপকার করণীয় জান,
পরম ধর্ম যদি ভকতিরে মান,
     তাহলে সত্য রত হও এক মনে
নিখিল পুরুষ-গুরু পিতার সেবনে।

শিক্ষক

শীলতা, বিষয়, বোধ, বহু শ্রম আর
প্রগাঢ় ভাবনা যেই কার্যলয়ের সাধন,
নিখিল সংসার যাবে পায় উপকার
যাহা বিনা তমোময় হেরি এ ভুবন;

তা হতে গৌরব-পদ কিংবা আছে আর ?
এ হেতু শিক্ষক কার্য্য সম্মান-আধার।

যেমতি ভিষকগণ ভেষজ বিধানে
নীরোগ করিয়া লোকে প্রদানে জীবন,
উপদেশ-দাতা তথা উপদেশ-দানে
নাশিদ তমঃ দেন জ্ঞান জীবন-জীবন।

যাঁহার কৃপায় শিশু বোধ-বিরহিত,
বিবেক-বিহীন, তমো মলিন-হৃদয়,
দারুর পুতলী সম অপর-চালিত,
বিজ্ঞান-গণিত-ধনে মহাজন হয়।

যাঁহার করুণাগুলে বালক অবল
নিখিল জীবের 'পরে অধিপতি হয়,
জানিয়া জগতী-পতি নিয়ম সকল
সুখের নীরধি-নীরে নিমগ্ন রয়।

তিনি হে পরম পূজ্য আচার্য্য তোমার,
জননী-জনক বিনা বিশাল ভুবনে
না হেরি ভকতি-পদ সমান তাঁহার,
রত রবে সদা তার আদেয় পালনে।

কঠোর শাসন তাঁর জেনো শুভময়,
কটুবাদ সাধুবাদ প্রাপণ-কারণ,
হে শিশু, বুঝিবে আশু কত সুখময়-
-মধুময়-সুধাময় তারি আচরণ।
_______

      রাজা  

   রাজা যে আমাদিগের গুরু, তাঁহাকে কোন সন্দেহ নাই। শাস্ত্র খালেদা বলেন যে, "অষ্টাভিশ্চ সুরেন্দ্রাণাং মাত্রাভি নির্ম্মিতো নৃপঃ।" অর্থাৎ রাজা অষ্টদিকপালের অষ্টমাত্রায় নির্ম্মিত হইয়াছেন। বস্তুতঃ ও যাঁহার প্রতি ভগবান্ কোটি কোটি মানবের উল্লিখিত ভার প্রদান করেন, তিনি সামান্য লোক নহেন। সেই ভগবন্নির্দ্দিষ্ট মহাপুরুষ যে ভক্তিভাজন ও গুরুপদ-বাঢ্য, তদ্বিষয়ে সংশয় করার কোনও কারণ নাই। অভিনিবেশ সহকারে বিচার করিলে প্রতীতি হইবে যে, যাঁহারা আমাদিগকে অসৎপথ হইতে নিবৃত্ত করিয়া সৎপথে পরিচালিত করেন, যাঁহারা আমাদিগের উন্নতি-সাধনে নিরন্তর ব্যাপৃত, সুতরাং যাঁহারা আমাদিগের ভক্তিভাজন, তাঁহারাই গুরু বলিয়া অভিহিত। রাজাও আমাদিগকে অসৎপথ হইতে নিবৃত্ত ও সৎপথে পরিচালিত করিতেছেন এবং আমাদিগের উন্নতির জন্য বিবিধ অনুষ্ঠানে নিরন্তর ব্যাপৃত রহিয়াছেন, সুতরাং রাজা আমাদিগের ভক্তির পাত্র ও গুরুজন। এ কারণ রাজার প্রতি ভক্তি ও বিশ্বাস করা অবশ্য কর্ত্তব্য। রাজভক্তি না থাকিলে অনন্ত জগতের রাজা জগদীশ্বরের প্রতি ভক্তি ও বিশ্বাস করা অসাধ্য।

   অন্যান্য গুরুজন

    অন্যান্য ভক্তিভাজন জনগণও আমাদিগকে অসৎপথ হইতে নিবৃত্তি করিয়া সৎপথে পরিচালিত করেন। ইঁহাদিগের যত্নে আমরা মৃতপিন্ডপ্রায় অবস্থাপন্ন থাকিয়াও জ্ঞানবর্ম্মের মূলসূত্রগুলি লাভ করিতে সমর্থ হই এবং ইঁহাদিগের চেষ্টায় আমরা পরাবিদ্যার অঙ্গস্বরূপ অপরাবিদ্যা প্রাপ্ত হইয়া প্রকৃত মানুষ্য নামের উপযুক্ত হইতে পারি, সুতরাং ইঁহারাও যে আমাদিগের গুরু পদবাচ্য; তাহা নিঃসংশয়ে বলা যাইতে পারে।

               - ঈশ্বর গুরুনাথ সেনগুপ্ত।      
   

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ