দান পরম গুণ।



                                          দান


       দান অতি প্রধান কার্য্য। এমন কি শাস্ত্রকারেরা বলেন যে, "দান হইতে দুষ্কর কার্য্য পৃথিবীতে নাই।" মানবগণে একেই ত অর্থে মহতী তৃষ্ণা, তাহাতে আবার ঐ অর্থ বহুকষ্টে লব্ধ হয়।

      দানান্ন দুষ্করং তাতে পৃথিব্যা মস্তি কিঞ্চন।
      অর্থে চ মহতী তৃষ্ণা স চ দুঃখেন লভ্যতে।।

   এই দান ত্রিবিধ। সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক। যে দান দ্বারা জগতের অনিষ্টোৎপত্তি হয়, তাহা তামসিক। যে দান স্বীয় দর্প-প্রকাশক ও যশের নিমিত্ত সম্পাদিত, তাহা রাজসিক দান। আর যে দান দ্বারা জগতে প্রকৃত মঙ্গল সাধিত হয়, তাহাই সাত্ত্বিক দান। সাধারণতঃ প্রকৃত অভাবগ্রস্ত দারিদ্রকে এবং সৎক্রিয়ান্বত সাধুদিগকে যে দান করা হয়, তাহাই সাত্ত্বিক দান ( তৎপাত্রং কেবলং দেবি দরিদ্রঃ সৎক্রিয়ান্বিতঃ।) হয়। মূল কথা, কাল, দেশ পাত্র অনুসারে প্রাণের সহিত যে দান, এবং অবশ্য দিতে হইবে--এই জ্ঞানে যে দান, তাহাকেই সাত্ত্বিক দান। এক্ষণে ত্রিবিধ দান উদাহরণ দ্বারা বুঝান যাইতেছে।


     তুমি যদি কালীকে কিছু অর্থ দাও এবং কালী ঐ অর্থ-সাহায্যে অপরের সর্ব্বনাশ করে, তবে তোমার ঐ দানে পুণ্যলাভ দুরে থাকুক, ঘোরতর পাপই এতাদৃশ দান তামসিক দান বলিয়া কীর্ত্তিত।

       যদি তুমি হরিকে এরূপ অর্থ দেও যে, তাহাতে হরির যত উপকার হউক বা না হউক, তোমার নাম চারিদিকে প্রসিদ্ধ হয় এবং তাহাই যদি তোমার উদ্দেশ্য থাকে, তবে তোমার ঐ দানে রাজসিক দান বলিয়া পরিগণিত হইবে। কিন্তু প্রেম-বশতঃ যদি কোনো প্রেমাস্পদের নাম চিরস্মরণীয় করিবার জন্য ঐরূপ দান করা যায়, তবে উহা রাজসিক দান বলিয়া পরিগণিত হইবে না। প্রভ্যূত উহা শুদ্ধ সত্ত্ব-গুণ-সম্ভূত দান বলিয়াই পরিকীর্ত্তিত হইবে। 


     অপর, জগতের অমঙ্গল ক্লেশ প্রভূতি নিবারণ এবং মঙ্গল ও সুখ প্রভূতির উৎপাদন যে দানের লক্ষ্য, তাহাই সাত্ত্বিক দান। সাত্ত্বিক ভাবের আরও উন্নতি হইলে, কার্য্য-কারণ-চিন্তারও অবসর থাকে না। তখন 'ইহা দিতেই হইবে' বলিয়া ধারণা জন্মে।

     শাস্ত্র খালেদা নানারূপ দানের নানা প্রকার গুণ কীর্ত্তন করিয়াছেন বটে, কিন্তু অন্নদানের তুল্য আর দান নাই, ইহাও নির্দেশ করিতে বিস্মৃত হন নাই। অন্য কোনও দান দ্বারা মানুষের তৃপ্তি-সস্পাদন সহজ ব্যাপার নহে, কিন্তু অন্নদ্বারা ঐ দুর্লভ তৃপ্তি-সম্পাদন অপেক্ষাকৃত অনায়াস-সাধ্য।
       মহর্ষি বেদব্যাসের মতেও দান ত্রিবিধ। যথা--

   অভিগম্য চ তত্তুষ্ট্যা দত্ত মাহু রভিষ্টুত তম্।
   যাচিতেন তু যদ্দত্তং তদাহু র্মধ্যমং বুধাঃ। 
   অবজ্ঞয়া দীয়তে যৎ তথৈবাশ্রদ্ধয়াঽপি বা।
   তমাহু রধমং দানং মুনয়ঃ সত্যবাদিনঃ।। ম০শা-২৯৩ অঃ

    --অর্থাৎ তত্তুষ্টির ( পাত্রতুষ্টির) নিমিত্ত দাতা তদীয় সমীপে গমন-পূর্ব্বক  যে দান করেন, পণ্ডিতেরা তাঁহাকে অভিষ্টুত (সর্ব্বতঃ প্রশস্ত) দান করেন। দাতা যাচিত হইয়া যে দান করেন, পণ্ডিতেরা তাঁহাকে মধ্যম দান করেন। আর অবজ্ঞা বা অশ্রদ্ধাপূর্ব্বক যে দান সেই দানাত্মক ধর্ম্মকে সত্যবাদী মুনিগণ অধম দান বলেন।


    শ্রুতিতে দান বহু প্রকার বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে। যথা- শ্রদ্ধেয়া দেয়াং, অশ্রদ্ধয়া দেয়ং, শ্রিয়া দেয়ং, প্রিয়া দেয়ং, মিয়া দেয়ং, সংবিধান দেয়মিতি শ্রুতি।

     --অর্থাৎ শ্রদ্ধাপূর্ব্বক দান, অশ্রদ্ধাপূর্ব্বক দান, শ্রীহেতুক দান, লজ্জাহেতুক দান, ভীতিহেতুক দান, এবং জ্ঞানপূর্ব্বক বা প্রতিজ্ঞা-পূর্ব্বক দান ইত্যাদি।
       অনুশাসন-পূর্ব্ব যুধিষ্ঠিরের প্রশ্নোত্তরে ভীষ্ম বলিয়াছেন--

     অভয়ং সর্ব্বভূতেভ্যো ব্যসনে চাপ্যনুগ্রহঃ।
     যচ্চাভিলষিতং দদ্যাৎ তৃষিতায়াভিযাচতে।।
     দত্তং মন্যেত যদ্ দত্ত্বা তদ্ দানং শ্রেষ্ঠমুচ্যতে।

   --অর্থাৎ সমূদায় প্রাণীকে যে অভয় দান এবং বিপৎকালে অনুগ্রহ করা, আর যাচমান তৃষিত ব্যক্তিকে অভিলষিথ বস্তু দান এবং যাহা দান করিয়া দত্ত বলিয়া মনে করা যায় অর্থাৎ ইহা আমার নহে বলিয়া মনে করা যায়, তাহাই (উক্ত চারিটিই) শ্রেষ্ঠ দান বলিয়া কথিত হয়।


    পূর্ব নানারূপ দানের বিষয় উক্ত হইল বটে, কিন্তু যিনি দান-গ্রহণ করেন না, বা সর্ব্বজনের দান-পরিগ্রহ করেন না, তাদৃশ মহাত্মা লিগের উদ্দেশে যে দান তাহাই সর্ব্বোৎকৃষ্ট।
আবার--

    সম অব্রাহ্মণে দানং দ্বিগুণং ব্রাহ্মণ ব্রুবে।
    অধীতে শত-সাহস্র্যম্ অনন্তং বেদপারগে।। মনুঃ

       --অর্থাৎ অব্রাহ্মণকে দান করিলে সম্বল, ব্রাহ্মণ শিশুকে দানে দ্বিগুণ, অধীতবেদ ব্রাহ্মণে দানে শত-সহস্র গুণ এবং বেদ-পারগে দানে অনন্ত ফল হয়। এতদ্বারা জানা যাইতেছে যে, যত উন্নত ব্যক্তিকে দান করিবে ততই অধিকতর ফল হইবে। কিন্তু বড়ই দুঃখের বিষয় এই যে, অত্যুন্নত মহাত্মারা। প্রায় কাহারো দান গ্রহণ করেন না। তুমি হয়ত তাঁহাকে দশদিন আহার করাইলে এবং তজ্জন্য মনে মনে ভাবিলে যে, ইনি আমার দান গ্রহণ করিয়াছেন কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাহা নহে। ঐ মহাত্মা ঐ দশদিনে যাহা আহার করিবেন, তাহা তিনি তোমাকে কোনো প্রকারে দিয়াই দশদিন তোমার গৃহে থাকিবেন। সুতরাং তুমি তাঁহাকে কিছুই দিতে পারিলে না।


    দানের মধ্যে ভূমি-দান অতি প্রধান। তৎপরে সুবর্ণ-দান।

      সর্ব্বান্ কামান্ প্রযচ্ছন্তি যে প্রযচ্ছন্তি কাঞ্চনম্।
      ইত্যেরং ভগবানত্রিঃ পিতামহ সুতোঽব্রবীৎ।।

    --যিনি স্বর্ণ দান করেন তাঁহার সমস্ত কাম্যবস্তু দান করা হয়। ইহা পিতামহ-সুত ভগবান অত্রি বলিয়াছেন।

      পানীয়ং পরমং দানং দানানাং মনুরব্রবীৎ।
      তস্মাৎ কূপাংশ্চ বাপীশ্চ তড়াগানি চ খানয়েৎ।।

   --মহর্ষি মনু বলেন যে, দানের মধ্যে পানীয়-দান পরম-দান। একারণে কূপ, বাপী ও তড়াগ খনন করাইবে।

   শাস্ত্র কারণ নানা দানের নানা ফল বর্ণনা করিয়াছেন। শাণ্ডিল্য ঋষির মতে শকট-দান অতি প্রধান দান। স্বর্ণ-দানের শ্রেষ্ঠা মহর্ষি অত্রিও যেমন বলিয়াছেন, হরিশ্চন্দ্র ও তদ্রূপ কীর্ত্তন করিয়াছেন। ইত্যাদি। অতঃপর মহাভারতে চর্ম্মপাদুকা-দান, তিল-দান, গো-দান, অন্ন-দান প্রভৃতির ফল বর্ণিত আছে। এস্থলে আর সেই সমস্ত বিষয়ের উল্লেখ করা প্রয়োজনীয় নহে। কৌতুহলী পাঠক মহাভারত পাঠেই তৎসমুদায় অবগত হইতে পারিবেন।


     অপর, এই পর্য্যন্ত কেবল দানের প্রশংসাই করা হইয়াছে, কিন্তু কতিপয় স্থলে ঐ দান বৃথাদান বলিয়া পরিগণিত। যথা--

     মার্কণ্ডেয় উবাচ। বৃথাজন্মানি চত্বারি, বৃথাদানানি ষোড়শ। বৃথা জন্মহ্যপুত্রস্য, যে চ ধর্ম্ম-বহিষ্কৃতাঃ। পরপাকেষু ষেঽশ্নন্তি, আত্মার্থন্তু পচেত্তু যঃ। পর্য্যশ্নন্তি বৃথা যত্র তদসত্যং প্রকীর্ত্ত্যতে। আরূঢ়-পতিতে দত্ত মন্যায়োপহৃতঞ্চ যৎ। ব্যর্থন্তু পতিতে দানং ব্রাহ্মণে তস্করে তথা। গুরৌ চানৃতিকে পাপে কৃতঘ্নে গ্রাম-যাজকে। বেদ-বিক্রয়িণে দত্তং তথা বৃষল-পাচকে। ব্রহ্ম-বন্ধুষু যদ্দত্তং যদ্দত্তং বৃষলীপতৌ। স্ত্রীরা ধেনু চ যদ্দত্তং ব্যালগ্রাহে তথৈবচ। পরিচারকেষু যদ্ দত্তং বৃথা দানানি ষোড়শ। --মার্কণ্ডেয় মুনি যুধিষ্ঠিরকে বলিতেছেন, --মানবের চারিটি জন্ম বৃথা ও ষোড়শ দান বৃথা। অপুত্রের জন্ম, এবং যে ধর্ম্ম-বহিষ্কৃত, যে পরের পাকে খায়, এবং যে কেবল আত্মার্থ পাক করে ও বালক, বৃদ্ধ, অতিথির পূর্বে আহার করে, তাহাদিগের ঐ চারি জন্ম অস্ত্র অর্থাৎ বৃথা। যে যাবজ্জীবন ব্রহ্মচর্য্য বা চতুর্থাশ্রম বাণপ্রস্থ অবলম্বন করিয়া উহা হইতে প্রচ্যুত হয়, তাঁহাকে দান (১), অন্যায়পূর্ব্বক দান। (২), পতিতে দান (৩), তষ্কর ব্রাহ্মণে ও গুরুতে দান (৪),(৫), অসত্য-পরায়ণে দান (৬), পাপাত্মায় (৭), কৃতঘ্নে (৮), গ্রাম-যাজকে (৯), বেদ-বিক্রেতায় (১০), শূদ্রের পাচকে (১১), অসচ্চরিত্র অজ্ঞান ব্রাহ্মণে (১২), শূদ্র-কন্যায় রত দ্বিজাতিতে (১৩), স্ত্রীলোকে (১৪), ব্যালগ্রাহে (১৫), পরিচালকের (১৬), যে দান তাহাই বৃথা দান বলিয়া গণ্য।

   এক্ষণে বক্তব্য এই যে, দান যখন অতি উৎকৃষ্ট কার্য্য এবং সর্ব্বদেশীয় জ্ঞানিগণই যখন সাত্ত্বিক দানের প্রশংসা করিয়া দিয়াছেন, তখন প্রত্যেক ধর্ম্মার্থী মানবের পক্ষে যথাসাধ্য দান যে একান্ত কর্ত্তব্য এবং গৃহাগত অতিথির পরিচর্য্যা করা যে নিতান্ত বিধেয়, তদ্বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই।

                                     ‌‌‌‌‌‌‌‌‌    -ঈশ্বর গুরুনাথ।